ইরফান খান। এই নামের সঙ্গে জুড়ে অভিনয়ের ব্যতিক্রমী ভাষা, গভীর অনুভূতি আর এক অপ্রকাশ্য শক্তি। কিন্তু তাঁর জীবনের শেষ সিনেমা ‘ইংরেজি মিডিয়াম’-এর শুটিংয়ের পেছনে যে কতটা শারীরিক যন্ত্রণা, অদম্য লড়াই আর চূড়ান্ত পেশাদারিত্ব লুকিয়ে ছিল, তা সম্প্রতি সামনে আনলেন ছবির কস্টিউম ডিজাইনার স্মৃতি চৌহান। তাঁর কথায়, সিনেমার সেটে প্রতিদিনই এক যন্ত্রণাক্লিষ্ট অথচ দৃঢ় মানসিকতার ইরফানকে দেখেছেন তিনি, যিনি শরীর ভেঙে পড়লেও ক্যামেরার সামনে শক্ত প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে থেকেছেন।

 

স্মৃতি জানান, শুটিং চলার সময়ই ইরফানের শারীরিক অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকে। “তিনি আমাকে বলতেন, ‘আমার খুব ঠান্ডা লাগে এখন।’ তাই তাঁর জন্য বিশেষ উষ্ণ পোশাকের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। উনিই বলে দিয়েছিলেন লন্ডনের কোন দোকান থেকে তাঁর জন্য শীতের মোটা জামাকাপড় কিনতে হবে। কিন্তু শুধু মোটা কাপড় দিলেই হচ্ছিল না কারণ তিনি রীতিমতো তখন ঠকঠক করে কাঁপতেন। প্রতিদিন যেন একটু একটু করে তাঁর শরীর খেয়ে যাচ্ছিল... তাঁর অনেক পোশাকে আলাদা করে প্যাডিং দিতে হতো,” বলেন তিনি। এমনকী এমন পরিস্থিতিও এসেছিল, যখন অসহ্য যন্ত্রণার কারণে এ ছবির একাধিক দিন শুটিং বাতিল করতে হয়েছিল। এতটাই শরীর খারাপ হয়ে যেত তাঁর যে বহু চেষ্টা করেও সেটে পৌঁছতে পারতেন না ইরফান।

 

কিন্তু শারীরিক দুর্বলতা যতই বাড়ুক, কাজের প্রতি ইরফান খানের দায়বদ্ধতা কখনও ভাঙেনি। পরিবার কাছে থাকলেও, মাঝে মাঝেই তাঁকে শুটিংয়ের মাঝপথে বিরতি নিতে হতো। তবু যখনই ক্যামেরা চালু হতো, ইরফান যেন আবার নতুন করে শক্তি পেতেন। স্মৃতির কথায়, “তিনি বিশ্বাস করতেন, এটাই তাঁর বেঁচে থাকার শক্তি। হয়তো মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলেন জীবনের শেষ পর্যন্ত অভিনয় করেই যেতে চান।”

 

হোমি আদাজানিয়ার পরিচালনায় তৈরি ‘ইংরেজি মিডিয়াম’ ছিল ইরফানের-ই অভিনীত ‘হিন্দি মিডিয়াম’-এর সিক্যুয়েল। রাধিকা মদন, করিনা কাপুর, দীপক ডোবরিয়ালদের মতো তারকাদের পাশে থেকেও ছবির আবেগকে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ইরফান। অথচ তখনই তিনি লড়ছিলেন এক ভয়ংকর অসুখ -নিউরোএন্ডোক্রাইন টিউমারের সঙ্গে। ২০১৮ সালে এই রোগের কথা নিজেই জানিয়েছিলেন তিনি। সেই মানুষটি ২০২০ সালে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। পেছনে রেখে যান অসংখ্য চরিত্র, অনন্ত স্মৃতি আর ভাঙা হৃদয়ের অগণিত দর্শক।

 

অবশ্য ইরফান খানের কেরিয়ার শুধু বলিউডেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ‘সালাম বোম্বে’ থেকে ‘দ্য ওয়ারিয়ার’, ‘মকবুল’, ‘হায়দার’, ‘দ্য লাঞ্চবক্স’, ‘পিকু’ একদিকে যেমন ভারতীয় সিনেমায় তিনি নিজের স্বাক্ষর রেখেছেন, অন্যদিকে ‘লাইফ অফ পাই’, ‘দ্য অ্যামেজিং স্পাইডার-ম্যান’, ‘ইনফার্নো’-র মতো আন্তর্জাতিক হলিউড প্রজেক্টেও ছড়িয়েছেন আলাদা পর্যায়ের অভিনয়।

 

 

আজ তাঁর আর্তি, যন্ত্রণা, সাহসের কথা যখন সামনে আসে, তখন আরও একবার মনে হয় ইরফান শুধু অভিনেতা নন; তিনি এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজের প্রতি প্রেম, লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছা এই শক্তিই তাঁকে চিরকাল আলাদা করে রাখবে। তাঁর রেখে যাওয়া শিল্প যেমন অমর, তেমনই অমর হয়ে থাকবে এই মানবিক সংগ্রামের গল্পও।