বাপি মণ্ডল,অশোকনগর: ছবি আঁকার প্রথাগত প্রশিক্ষণ তিনি পাননি। হা-ঘরের অবহেলিত ছেলেকে কোনও বড় শিল্পী কখনও তালিম দিতেও চাননি। তবু রং-তুলিই তাঁর জীবনের একমাত্র সহচরী। অনুচিত্র অঙ্কনই তাঁর স্বপ্ন ও সাধনা। তুলির জাদুতে ইতিমধ্যে বহু মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। দেবীপক্ষে এবার রসগোল্লার ওপর দশভুজার ছবি এঁকে শিল্পী বাসু সবার নজর কেড়েছেন। 

বাসুর পোশাকি নাম বাসুদেব পাল। ‌ঠিকানা, উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরের কচুয়া ঘোষপাড়া। বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই। দু'কামরার ছোট্ট ঘরে স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে তাঁর ঘরকন্না ও দিনযাপন। বাবা ছিলেন পেশায় কুমোর। মাটির হাঁড়ি-খুড়ি গড়তেন। বাবার পাশে বসে একরত্তি বাসুদেবের মনে কখন যে শিল্পী হওয়ার বাসনা জেগে উঠেছিল, তা কেউ জানেন না। ছেলেবেলায় পাঠশালায় পড়ার সময় অঙ্কের খাতায় দেশের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ছবি এঁকেছিলেন। তার জন্য শিক্ষকের কাছে তাঁকে বিস্তর ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছিল। সেদিন থেকে তিনি আর কখনও কাগজের ওপর ছবি আঁকেননি। 

 

ছবি আঁকার জন্য বিকল্প অবলম্বন বেছে নিয়েছিলেন। ২০০০ সালে মটর ডালের ওপর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি এঁকে তিনি আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে একে একে চুলের ওপর ইংরেজি অক্ষরে ইন্ডিয়া লিখেছেন। দেশলাইয়ের একটি কাঠির ওপরে বিদ্যাসাগরের ছবি ও গোটা বাংলা বর্ণমালা লিখেছেন। পোস্তদানার ওপর এঁকেছেন জাতীয় পতাকা। একটি চালের ওপরে একসঙ্গে ঠাকুর রামকৃষ্ণ, সারদা দেবী ও স্বামী বিবেকানন্দের ছবি এঁকেছেন। অনুচিত্রশিল্পী হিসেবে দিনে দিনে বাসুদেবের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।

 

২০২০ সালে করোনার সময় কমলালেবুর দানার ওপরে মা সরস্বতী ছবি এঁকেছিলেন। ওই ছবির জন্য তাঁর নাম ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডসে নথিভুক্ত হয়েছে। পেয়েছেন জাতীয় স্তরের শংসাপত্রও। বাসুদেবের স্বপ্ন, গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে একদিন তাঁর নাম লেখা হবে। নিজের ছবিগুলোর নথি তিনি মেল করে গিনেস কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছেন। তারা প্রাপ্তি স্বীকারও করেছে। এখন কেবল স্বীকৃতির পথ চেয়ে থাকা। 

 

জীবন-জীবিকার তাগিদে বাসুদেব কেবল ছবি নিয়ে ভাবতে পারেন না। ছেলে বড় হচ্ছে। তাই, সংসারের জোয়াল বইতে বেছে নিয়েছেন স্ক্রিন প্রিন্টিংয়ের কাজ। তাতে ক'টাকাই বা হয়! সম্প্রতি বাসুদেব রসগোল্লার ওপরে রং-তুলিতে দেবী দুর্গার ছবি অঙ্কন করেছেন। আর তা দেখতে ভিড় করছেন মহল্লার অনেকেই। শিল্পী বাসুদেবের চোখে অনেক স্বপ্ন রয়েছে। কিন্তু তা তিনি সফল করতে পারেননি। বাসুদেব বলেন, 'অনুচিত্র আঁকাই আমার স্বপ্ন ও সাধনা। কিন্তু সারাদিন ছবি নিয়ে থাকতে পারি না। কী করব বলুন? ছেলে বড় হচ্ছে। ছবি এঁকে মন ভরে। কিন্তু পেট যে ভরে না।' 

 

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'শিল্পী' গল্পে মদন তাঁতি শিল্পকে ভালো বেসেছিলেন। নিদারুণ দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে জিততে পারেননি। নিশুত রাতে শূন্য তাঁতঘরে মদন একা একা কথা বলতেন। অশোকনগরের বাসুদেবও যেন সেই মদন তাঁতি। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। পুকুরপাড়ে ঝিঁঝিপোকা ডাকে। বাসুদেব একা একা ছবি আঁকেন। দু'চোখে স্বপ্ন। যদি কোনওদিন আলোর দেখা মেলে।