আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভারতে হিন্দুদের তুলনায় মুসলিমদের মধ্যে শিশুমৃত্যু হার কম—এই দাবি করে এক দশক আগে ভারতে আলোড়ন তুলেছিলেন মার্কিন অর্থনীতিবিদ ডিন স্পিয়ার্স ও মাইকেল জেরুসো। ২০১৪ সালে প্রকাশিত তাদের সেই গবেষণা আবার শিরোনামে এসেছে তাদের সদ্যপ্রকাশিত বই After the Spike: Population, Progress, and the Case for People ঘিরে। বইটিতে তারা সতর্ক করেছেন, “মানবসভ্যতা একটি জনসংখ্যা-হ্রাসের পথে হাঁটছে”—এই বার্তাকে কেন্দ্র করে নতুন বিতর্কের জন্ম হয়েছে, যার পেছনে আছে খোদ এলন মাস্কের আর্থিক অনুদান। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে জেরুসো ও স্পিয়ার্স একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, নাম—Sanitation and health externalities: Resolving the Muslim mortality paradox। সেখানে তারা দাবি করেন, ভারতের মুসলিমদের মধ্যে গড়ে আয় ও শিক্ষার হার কম হলেও শিশু মৃত্যুর হার হিন্দুদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। কারণ? হিন্দুরা মুসলিমদের তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি খোলা জায়গায় শৌচকর্ম করেন, যার ফলে জলবাহিত রোগ ও সংক্রমণ ছড়ায়।
তাদের গবেষণায় ভারতের তিনটি জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার (NFHS) তথ্য ব্যবহার করা হয়—১৯৯২–৯৩, ১৯৯৮–৯৯ ও ২০০৫–০৬। এই তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রায় ৩.১ লক্ষ হিন্দু ও মুসলিম শিশুর মধ্যে মুসলিম শিশুদের মধ্যে এক বছরের আগেই মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। এই গবেষণার পরে বিতর্ক শুরু হয় ভারতে। অনেকেই এটিকে ধর্মীয় তুলনার মাধ্যমে সামাজিক বিভাজন ও হিন্দু সমাজকে অপমান করার চেষ্টা হিসেবে দেখেন। কিন্তু গবেষকদ্বয় পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে দাবি করেন, এই পার্থক্য সামাজিক আচরণগত কারণেই।
আরও পড়ুন: মার্কিন দেশে সংক্রামক রোগের শিকার আট থেকে আশি, ছড়াতে পারে বিশ্বের বাকি দেশেও
২০১৪ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী 'স্বচ্ছ ভারত মিশন' শুরু করেন। তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল খোলা জায়গায় শৌচকর্ম বন্ধ করা। প্রশ্ন উঠেছে, এত বছর পর সেই পরিস্থিতি কি বদলেছে? এই প্রশ্নে মাইকেল জেরুসো দ্য টেলিগ্রাফ অনলাইন-কে বলেন, “ডিন স্পিয়ার্সের মতে, এখনো পর্যন্ত স্বাধীন ও নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি, যা আলাদা করে ‘ল্যাট্রিন মালিকানা’ ও ‘ল্যাট্রিন ব্যবহার’-এর মধ্যে পার্থক্য করে।” তিনি স্বীকার করেন, “NFHS-5 (২০১৯–২১) অনুযায়ী খোলা শৌচের হার কমেছে, কিন্তু উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের মতো রাজ্যে এখনো এই প্রবণতা বেশ উদ্বেগজনক।”
তবে তিনি যোগ করেন, “ভবিষ্যতের লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একটি ভারত গঠন করা যেখানে কোনো শিশুই খোলা শৌচের কারণে অসুস্থ হবে না—সে হোক হিন্দু বা মুসলিম।” ডিন স্পিয়ার্স ও মাইকেল জেরুসোর সদ্যপ্রকাশিত বই After the Spike বলছে, “মানবসভ্যতা ধীরে ধীরে এক জনসংখ্যা-হ্রাসের যুগে প্রবেশ করছে”—এটি জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও বৈষম্যের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। তারা বলেন, “বড় জনসংখ্যা থাকলে মহামারি বা কার্বন দূষণের মতো সমস্যা মোকাবেলায় মানবতা অধিক প্রস্তুত থাকে।”
তবে সমালোচকদের একাংশ দাবি করছেন, বইটির বক্তব্য এলন মাস্কের ‘ডিপপুলেশন থিয়োরি’-কে সমর্থন জোগাচ্ছে। প্রসঙ্গত, মাস্ক নিজেই ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসের Population Wellbeing Initiative (PWI)-কে ১ কোটি ডলার অনুদান দিয়েছেন, যার সঙ্গে যুক্ত এই দুই অর্থনীতিবিদ। এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জেরুসো বলেন, “বইটি আমাদের নিজের মতামতের প্রতিফলন। কোন অনুদানদাতা, এমনকি এলন মাস্ক বা বিল গেটসও আগে থেকে বইটি পড়ে মতামত দেননি। তাদের সহায়তা গবেষণার প্রাথমিক স্তরে ছিল, কোনো মতাদর্শগত হস্তক্ষেপ ছিল না।” 'গ্রহাণুর মতো সমস্যা'—কেন ব্যবহার করলেন এই রূপক? After the Spike বইতে তারা বলেন, জনসংখ্যা হ্রাস কোনো গ্রহাণু আঘাতের মতো হতে পারে—একটি বৃহৎ, ধ্বংসাত্মক বিপর্যয়। এই রূপক নিয়ে সমালোচকদের আপত্তি থাকলেও লেখকদের দাবি, “এগুলো কেবল রূপক, বাস্তবতা বোঝানোর জন্য সহজীকরণ।”
জেরুসো বলেন, “যদি কোনো বিশাল চ্যালেঞ্জ (যেমন: নতুন ভাইরাস বা জলবায়ু সংকট) সামনে আসে, বড় জনসংখ্যা না থাকলে তা মোকাবেলা করাই কঠিন হবে। আমাদের বইয়ে এই বিষয়টাই তুলে ধরা হয়েছে।” ডিন স্পিয়ার্স ও মাইকেল জেরুসোর গবেষণা ও লেখা একদিকে যেমন ধাক্কা দেয় প্রচলিত বিশ্বাসকে, তেমনি উস্কে দেয় নীতিগত বিতর্ক। এক দশক আগে খোলা শৌচ ও ধর্মভিত্তিক শিশুমৃত্যু নিয়ে তাদের গবেষণা ভারতের জনস্বাস্থ্য নীতিতে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। এবার তারা বলছেন, জনসংখ্যা হ্রাস মানব সভ্যতার নতুন সংকট। আর এই দুই অধ্যাপক যদি সঠিক হন, তাহলে আমাদের ভাবনার ক্ষেত্র বদলাতে হতে পারে—শুধু ভারতের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্য।
