কৃশানু মজুমদার: বাইশ গজে তাঁর ও সদ্য প্রয়াত প্রাক্তন তারকা ক্রিকেটার  দিলীপ দোশীর কথোপকথন কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। জনপ্রিয় এক টিভি শোয়ে ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার সুনীল গাভাসকরকে সেই গল্প বলতে শোনা  গিয়েছিল। 

দিলীপ দোশীর সঙ্গে যাঁর নাম জড়িয়ে রয়েছে, সেই জাভেদ মিয়াঁদাদ ভারতের প্রাক্তন স্পিনার সম্পর্কে বলছেন, ''দিলীপ দোশী পারফেক্ট জেন্টেলম্যান। ওঁর প্রয়াণের খবর পেয়েছি। একসঙ্গে খেলেছি আমরা। লন্ডনেই থাকত। যাওয়া-আসা পৃথিবীরই নিয়ম। আমাদের সবাইকে এই নিয়ম মানতে হবে। চিরকাল আমরা কেউই থাকব না।'' 

আজকাল ডট ইনের কাছে মিয়াঁদাদ যখন এই কথাগুলো বলছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল, তিনিই কি সেই ক্রিকেটার যিনি চেতন শর্মাকে শেষ বলে ছক্কা মেরে জয় ছিনিয়ে নিয়েছিলেন? ওই ছক্কার অভিঘাতে পাকিস্তানকে দেখলেই কুঁকড়ে থাকত ভারত। বাইশ গজে পাক-ভীতি কাটাতে দীর্ঘসময় লেগেছিল ভারতের।  

তিরাশির বেঙ্গালুরু টেস্টে দিলীপ দোশীকে বিরক্ত করেছিলেন তিনিই? ব্যাট ঠুকতে ঠুকতে বলেছিলেন, ''তেরা রুম নাম্বার ক্যায়া হ্যায় রে?'' 

অজি কিংবদন্তি ডেনিস লিলিকে ব্যাট দিয়ে মারতে গিয়ে কুখ্যাত এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন? যৌবনের সেই তেজ আর শরীরে নেই। সময় শুষে নিয়েছে অনেককিছু। 

দিলীপ দোশী ও তাঁর সেই বহুল প্রচলিত গল্প নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মিয়াঁদাদ হাসেন। বলেন, ''সানি ভাই এই গল্প খুব করেন। আমি মাঠে খুব জ্বালাতন করতাম। এখনকার সময় হলে কী হত বলা মুশকিল। আইসিসি এখন খুব কড়া। কত নিয়ম সব! আমি দিলীপ দোশীকে বলেছিলাম, আরও দু-একটা প্লেয়ার বাউন্ডারি লাইনে রাখো। ছক্কা মেরে তোমার হোটেলের ঘরে আমি বল ফেলবো।''   

দেশের দুই প্রাক্তন ক্রিকেটার সুনীল গাভাসকর, রবি শাস্ত্রী এখনও টেলিভিশন শোয়ে মজা করে বলে থাকেন, জাভেদকে বশ করা ছিল সব থেকে কঠিন কাজ। খেলা চলাকালীন হঠাৎ হঠাৎ ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের বিরক্ত করার জন্য বলে উঠতেন, ''বারো নম্বর ডাল।''

পুরনো দিনের কথা উঠলে হাসেন মিয়াঁদাদ। স্মৃতিচারণ করে বলছেন, ''আমরা মাঠের ভিতরে অনেক কথা বলতাম। কিন্তু মাঠের বাইরে বন্ধুত্ব ছিল সবার সঙ্গে। একসঙ্গে খেতে যেতাম। তখনকার সময়ে নিয়ম এখনকার মতো কড়া ছিল না। এখন তো ক্রিকেট অনেক বদলে গিয়েছে।''

ভারতের প্রাক্তন স্পিনার চলে গিয়েছেন ২৩ জুন। আজ ২৫ জুন। ১৯৮৩ সালের আজকের দিনে কপিল দেব নিখাঞ্জের হাতে বিশ্বকাপ উঠেছিল। সেই রূপকথার ৪২ বছর পূর্তি। ক্রিকেটপাগলদের মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা। 

তিরাশির সেই বিশ্বজয়ের দিন কি আদৌ মনে আছে মিয়াঁদাদের? না থাকারই কথা। তিনি ভিনদেশের ক্রিকেটার। ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের দিন মনে রাখবেন কেন? প্রাক্তন পাক ক্রিকেটারের পালটা প্রশ্ন, ''আজকের দিনে ভারত বিশ্বকাপ জিতেছিল তিরাশি সালে? আমাকে আপনি অনেক পুরনো দিনে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। এই মুহূর্তে সেই সব স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গিয়েছে।  ভারতকে অভিনন্দন জানাই। কোথাও একটা শুরু করতে হয়। তিরাশি ছিল সেরকমই একটা বছর। ভারত বিশ্বজয়ী হয়েছিল। আগামী প্রজন্মকেও বলব প্রাক্তনরা যে পথ দেখিয়ে গিয়েছেন, সেই রাস্তা ধরে তারাও এগিয়ে চলুক। দেশকে সম্মান এনে দেওয়াই শেষ কথা।''

তিরাশির লর্ডসে কপিলদের সোনার ইতিহাস। আর মঙ্গলবার লিডসে শুভমান গিলের রণতরী ডুবল। দুই ভিন্ন সময়। ভিন্ন প্রতিযোগিতা। ভিন্ন প্রেক্ষিত। নবীনরা টেস্ট জিতে প্রাক্তনদের অভিনন্দন জানাতে পারতেন। সেটা হল না। টেস্ট সিরিজের শুরুতেই পিছিয়ে পড়তে হল। মিয়াঁদাদ কি দেখেছেন ভারতের হার? পাকিস্তানি মহাতারকা বলছেন, ''ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট আমার দেখা হয়নি। তবে শুনেছি শেষদিনে ৩৫০ রান করে জিতেছে ইংল্যান্ড। আমাদের সময়ে এসব ভাবাই য়েত না। একদিনে সাড়ে তিনশো রান! অবিশ্বাস্য লাগছে। আমাদের সময়ের সঙ্গে আজকের সময়ের ক্রিকেটের তুলনা করবেন না। অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগের সময়ের ক্রিকেটে তো সারা দিন খেলার পর দেখা যেত মাত্র পঞ্চাশ রান হয়েছে। এখনকার টেস্টে ফলাফল হচ্ছে। ইতিবাচিক দিক অনেক।'' 

বিরাট কোহলি টেস্ট ফরম্যাট থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। রোহিত শর্মাও তাই। কোহলি-রোহিতের বিকল্প নেই এই ভারতে। দুই ভারতীয় মহাতারকা টেস্ট ফরম্যাট থেকে সরে দাঁড়ানোয় কি শূন্যতা তৈরি হল না বিশ্ব ক্রিকেটেও? মিয়াঁদাদের সাফ জবাব, ''সবকিছুর মতো সরে যাওয়ারও টাইমিং রয়েছে। একেক জন থাকে, যাদের ধাক্কা মেরে সরাতে হয়। সময় থাকতে থাকতে অবসর নেওয়াই উচিত। সবার মনে যাতে সেই ক্রিকেটারের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় থাকে।'' 

মিয়াঁদাদ মানে অবাধ্য এক ক্রিকেটার। মিয়াঁদাদ মানেই বিতর্কের বীজ বোনা। কে ভুলতে পারবেন বিরানব্বই সালে কিরণ মোরের সঙ্গে সেই ঘটনা? তিনি লাফিয়ে ব্যঙ্গ করছেন মোরেকে। পুরনো ঘটনা কি লজ্জায় ফেলে দেয় প্রাক্তন তারকাকে? সেদিন মোরেকে কী বলেছিলেন আপনি? মিয়াঁদাদ বলছেন, ''হিট অফ দ্য মোমেন্ট অনেক কিছুই হয়। অনেক কথা বলে ফেলি। তারকা ক্রিকেটারদের দেখেই কিন্তু অনুপ্রাণিত হয় পরের প্রজন্ম, ক্রিকেট খেলতে আসে তারা। এটা সবারই মাথায় রাখা উচিত। এমন কিছু করা উচিত নয়, যাতে তাদের মনে অন্য ছাপ পড়ে।''  

৬৮-র জাভেদ মিয়াঁদাদের কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, আগের সেই সব বিতর্কের জন্য তিনি বোধহয় এখন অনুতপ্ত। অলস কোনও সময়ে পুরনো ঘটনা তাঁকে পীড়া দেয়। ভিনদেশি এক সাংবাদিকের মনে হয়, তাঁকে বুঝতে পারেননি বিপক্ষের ক্রিকেটাররা। ক্রিকেট মাঠে তিনি দুর্ধর্ষ এক প্রতিদ্বন্দ্বী যিনি জেতার জন্য সব করতে পারেন। মাঠের বাইরে সম্পূর্ণ অন্য এক মেরুর বাসিন্দা। ধাঁধার থেকেও জটিল হয়ে থেকে গিয়েছেন জাভেদ মিয়াঁদাদ।