কৃশানু মজুমদার: ভাইচুং ভুটিয়া থেকে কিয়ান নাসিরির ডার্বি হ্যাটট্রিক। লাল-হলুদ জার্সি পরে কপিলদেব নিখাঞ্জের বড় ম্যাচে নেমে পড়া।
বাঙালির চিরআবেগের ইস্ট-মোহন লড়াই লিখে গিয়েছে অসংখ্য রূপকথা। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভারতীয় ফুটবলে এসেছে আইএসএল। পরিবর্তন এসেছে ফুটবলের সবুজ গালচেতেও।
মাঠের ফুটবলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পালাবদলও ঘটেছে ধারাভাষ্যের ইতিহাস। রেডিওর চৌখুপি থেকে টিভি, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে লাইভ ধারাভাষ্য–আমূল বদলে গিয়েছে শ্রবণের মাধ্যম-ও।
দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের ধারাভাষ্য জীবনে ৯৭টি ডার্বিতে তাঁর গলার জাদুতে মজেছে বাংলার ফুটবলপ্রেমী মানুষ। থুড়ি এই ডিজিটাল যুগে তিনি দেশের সীমানা অতিক্রম করে পৌঁছে গিয়েছেন বিশ্বের অসংখ্য বাঙালি ফুটবলপ্রেমীর মননেও।

তিনি প্রদীপ রায়। আজ শিল্ড ফাইনাল তাঁর ৯৮-তম বড় ম্যাচ। ডার্বিতে কমেন্ট্রি করার সেঞ্চুরি হাঁকানো থেকে থেকে আর ঠিক দুই ম্যাচ দূরে দাঁড়িয়ে তিনি। আজ তাঁর নতুন সঙ্গী দুলাল দে। অভিজ্ঞ প্রদীপের সঞ্চয়ের ঝুলিতে রয়েছে অসংখ্য গল্প। যা ভাবীকালের ফুটবলপাগলদের কাছে আকর হয়ে দেখা দিতেই পারে।
শনিবারের সন্ধ্যায় শহরের সব রাজপথ এসে মিশবে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। ৯৮-নম্বর ডার্বিতে ধারাভাষ্য দেওয়ার আগে ডার্বির 'প্রদীপ' জ্বালছেন তিনি। দীর্ঘ ইস্ট-মোহনের সাক্ষাতের তালিকায় সবার আগে তিনি রাখছেন ১৯৯৭ সালের ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনালকে।
সেদিন বাঙালির বড় ম্যাচ সব রেকর্ড ভেঙে তছনছ করে দিয়েছিল। খেলার আগেই আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন মোহনবাগান কোচ অমল দত্ত। লাল-হলুদের ভাইচুংকে 'চুমচুম', স্যামি ওমোলোকে 'ওমলেট' বলে তাতিয়ে দিয়েছিলেন পিকের ইস্টবেঙ্গলকে।
যুবভারতী সেদিন দেখেছিল ১ লক্ষ ৩৩ হাজার দর্শকের জনবিস্ফোরণ। কিন্তু সেই ম্যাচে যে তিনি ধারাভাষ্য দেবেন তা আগাম জানতেনই না। স্মৃতির পাতা উল্টে প্রদীপ রায় বলছেন, ''১৯৯৫ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত কলকাতা ফুটবল লিগের সম্প্রচার স্বত্ব ছিল ইএসপিএনের কাছে। তখন আমি ধারাভাষ্য জীবনের মধ্যগগনে। ইএসপিএনের কাছে রাইট থাকলেও তারা খেলা দেখাত না। ফলে ধারাভাষ্যকাররা বঞ্চিত হয়েছিলেন সেই সময়ে। নইলে এতদিনে আমার একশোর বেশি ডার্বিতে ধারাভাষ্য হয়ে যেত।''
ফেডারেশন কাপে অমল দত্তর ডায়মন্ড সিস্টেম সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ইস্টবেঙ্গল 'হিরের দর্পচূর্ণ' করেছিল সেদিন। ভাইচুং একাই শেষ করে দিয়েছিলেন মোহনবাগানকে। লাল-হলুদের হয়ে প্রথম গোলটি করেছিলেন নাজিমুল হক। স্মৃতির পাতা ওল্টাচ্ছেন প্রদীপ, ''১৯৯৭ সালের সেই ফেডারেশন কাপের সেমিফাইনালটা দূরদর্শনে শেষ পর্যন্ত দেখানো হয়েছিল। সে এক বড় ঘটনা। আমাদের বলা হয়েছিল, বাড়ি থেকে আমরা কোথাও যেন না বেরোই। সেই সময়ে মমতা ব্যানার্জি সংসদে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বাংলার গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা মানুষ বাংলায় ফুটবল ধারাভাষ্য শুনবেন না! স্পেশাল কেস হিসেবে ওই সেমিফাইনাল শেষমেশ দেখিয়েছিল দূরদর্শন।''
সেই বিখ্যাত-ডার্বিতে ধারাভাষ্য দেওয়ার অভিজ্ঞতাও কম রোমহর্ষক ছিল না। পিছনের দিকে তাকিয়ে বর্ষীয়ান ধারাভাষ্যকার বলছেন, ''মানসিক প্রস্তুতির একটা ব্যাপার থাকে। কিন্তু আদৌ খেলা দেখানো হবে কিনা সেটাই তো বোধগম্য হচ্ছিল না। বারংবার ফোন করে আপডেট নিচ্ছিলাম। বেলা বারোটা নাগাদ খবর এল ম্যাচ সম্প্রচার করা হবে। আমি কোন্নগর থেকে স্কুটার নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তার পর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যখন ধারাভাষ্য দিতে ঢুকছি তখন দেখি আমার সতীর্থ ভাষ্যকার জয়ন্ত চক্রবর্তী এসে উপস্থিতই হয়নি। হাঁপাতে হাঁপাতে আমি শুরু করে দিই। জয়ন্ত এল পনেরো মিনিট পর। আমি বললাম, নাও এবার মাইক্রোফোনটা ধরো। জয়ন্তও তখন হাঁপাচ্ছে। ওর হাতে মাইক্রোফন তুলে দিয়ে আমি ঢকঢক করে জল খেলাম।''

২০০৯ সালের মহাকাব্যিক ডার্বি দেখেছিল গোলের ফল্গুধারা। আট গোল হয়েছিল ম্যাচে। নাইজেরীয় এডে চিডি একাই দিয়েছিলেন চার-চারটি গোল। খেলার ফলাফল হয়েছিল মোহনবাগান ৫ ইস্টবেঙ্গল ৩। প্রেস বক্সে এক মোহনবাগান সমর্থক ঢুকে পড়ে হাতের পাঞ্জা তুলে দেখাচ্ছিলেন, ''পাঁচ-পাঁচ।'' প্রদীপবাবু একনিঃশ্বাসে বলে চলেন, ''চিডির হ্যাটট্রিকের ডার্বিতে আমার সঙ্গে সতীর্থ ধারাভাষ্যকার ছিল মানস ভট্টাচার্য। আবার ২০২২ সালে তিলক ময়দানে কিয়ান নাসিরির হ্যাটট্রিকে মোহনবাগান ৩-১ গোলে হারিয়েছিল ইস্টবেঙ্গলকে। সেই ম্যাচে আমার সতীর্থ ধারাভাষ্যকার ছিল রজত ঘোষদস্তিদার ও রহিম নবি।''
ডার্বিতে প্রথম ধারাভাষ্য তিনি দেন কিংবদন্তি পুষ্পেন সরকারের সঙ্গে। সেটাও ছিল আজকের মতোই এক শিল্ড ফাইনাল। ইস্টবেঙ্গল মাঠে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে গৌতম সরকারের গোলে জিতেছিল মোহনবাগান।
কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামের উদ্বোধনে বরেণ্য অজয় বসুর সঙ্গে ধারাভাষ্য দেওয়ার স্মৃতি এখনও প্রদীপ রায়ের শয়নে, স্বপনে, জাগরণে ধরা দেয়। সেই ডার্বির পরে রাতে অজয় বসুর কাছ থেকে ধ্রুপদী সঙ্গীত ছিল বড় পাওনা। এখনও ভুলতে পারেন না অজয় বসু-পুষ্পেন সরকারের সাহচর্য। দিকপাল দুই ধারাভাষ্যকার এখনও রয়ে গিয়েছেন প্রদীপবাবুর অনুভূতিতে।
দর্শকশূন্য ডার্বিতে ধারাভাষ্য দেওয়ার অভিজ্ঞতা আবার অন্যরকমের। বাড়ি থেকে কমেন্ট্রিও দিয়েছেন তিনি। হরেক রকমের অভিজ্ঞতা তাঁকে প্রতি মুহূর্তে করে তোলে পরিণত থেকে আরও পরিণত। এটা তাঁর কাছে প্যাশন হয়ে ধরা দিয়েছে। বাঙালির রান্নঘরে পৌঁছে গিয়েছে তাঁর কণ্ঠস্বর। অভিজ্ঞ ধারাভাষ্যকার বলছেন, ''বাড়ি থেকেও যে কমেন্ট্রি করা যায় তা দেখিয়ে দিয়েছিল স্টার সস্পোর্টস। ২৫ অক্টোবর, ২০২২-এর দর্শক শূন্য ডার্বিতে হুগো বুমো আর মনভীরের গোলে ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়েছিল মোহনবাগান।''

প্রাক্তন ফুটবলার কার্তিক শেঠের সঙ্গে তাঁর তৈরি হয়েছিল অদ্ভুত এক যোগসূত্র। তিনি ধারাভাষ্যকার হিসেবে থাকলেই কার্তিক শেঠ গোল করতেন। সেই অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন প্রদীপবাবু, ''১৯৮২ সালের ১০ জুলাই ছিল ডার্বি। পরের দিন ফিফা বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি ইতালি ও পশ্চিম জার্মানি। কাগজে শিরোনাম হয়েছিল, বিশ্বের দুই প্রান্তে দুই ডার্বি। তিল ধারণের জায়গা ছিল না সেদিনের ইডেন গার্ডেন্সে। কার্তিক শেঠের গোলে ইস্টবেঙ্গল জিতেছিল। পরের দিন আবার ইতালি বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছিল। ১৯৮৪-র শিল্ড ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২৮ সেপ্টেম্বর যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। সেটি ছিল যুবভারতীতে প্রথম ডার্বি। কার্তিক শেঠ গোল করেছিল সেই ম্যাচে। এশিয়ান গেমসে মালয়েশিয়া-চিন ম্যাচে আমি ধারাভাষ্য দিয়েছিলাম। সেই ম্যাচেও কার্তিক শেঠ গোল করেছিল। ফলে একটা লিঙ্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল ওর সঙ্গে।''
ক্রিকেটপাগলরা বলতেন ঈশ্বরদত্ত আউটসুইংয়ের অধিকারী কপিলদেব নিখাঞ্জ। তিরাশির বিশ্বজয়ী অধিনায়ক খেলেছেন বাংলা ভাগ হয়ে যাওয়ার ম্যাচও। কপিল বেশিক্ষণ মাঠে থাকতে পারেননি। পরে প্রদীপবাবুর কাছে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক বলেছিলেন, ''উফফ সে এক অভিজ্ঞতা! আমি বল ধরলেই লোক চিৎকার করছিল। তবে ফুটবলে ফিটনেসই শেষ কথা নয়। উচ্চ পর্যায়ের ফুটবল খেলতে হলে দরকার স্কিল।''
দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের ধারাভাষ্যকার জীবনে জয়ন্ত চক্রবর্তীর সঙ্গে ৪০টা ডার্বিতে ধারাভাষ্য দিয়েছেন তিনি। ২০টা বড় ম্যাচে তাঁর সতীর্থ ছিলেন মানস ভট্টাচার্য। অজয় বসু ও সুকুমার সমাজপতির সঙ্গে দশটা করে ডার্বিতে কমেন্ট্রি দেওয়ার অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাঁর। রয়েছে পিকে ও প্রসূন-দুই ভাইয়ের সঙ্গে ধারাভাষ্য দেওয়ার অভিজ্ঞতাও।
গতবছরের ইস্ট-মোহন ম্যাচে সুব্রত ভট্টাচার্য, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ও সৌমিত্র চক্রবর্তীর মতো তিন বিখ্যাত বিশেষজ্ঞকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন ফুটবলমহলকে। সেই ম্যাচে শেষ হাসি তোলা ছিল লাল-হলুদের জন্য। আবার ২০১৪ সালের কলকাতা লিগের ম্যাচে বরেণ্য দুই কোচ পিকে-অমল এবং সহ-ভাষ্যকার দেবব্রত মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এক মুঠো সোনালী রোদ্দুর। হালআমলের মেবতাব-নবির সঙ্গেও তাঁর যুগলবন্দি মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে শ্রোতাদের। আজ ইস্ট-মোহনের লড়াইয়ের আকর্ষণে ফুটতে শুরু করেছে গোটা বাংলা। বারুদে ঠাসা সেই ম্যাচে প্রদীপ জ্বালানোর অপেক্ষায় অভিজ্ঞ ধারাভাষ্যকার।
আরও পড়ুন: এশিয়ান কোয়ালিফায়ারে হারের জের, ফিফা ব়্যাঙ্কিংয়ে আরও পতন, ভারতীয় ফুটবলের দৈন্যদশা আরও স্পষ্ট
