কৃশানু মজুমদার: শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, 'মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।' কিংবদন্তি শ্যাম থাপার বাড়ির ড্রয়িং রুমে সারি সারি পুরস্কার দেখে বলাই যায়, 'মুখ ঢেকে যায় পুরস্কারে।'
শ্যাম থাপার মুখে খেলা করে প্রশান্তির হাসি। ময়দানের 'ব্যাকভলি কিং' মনে করিয়ে দেন সেই মিডাস রাজার কথা। মাঠে নেমে সোনা ফলাতেন তিনি। সেই 'রকস্টার' হাসতে হাসতেই ভাগ্যকে দুষছেন এখন। বলতে থাকেন, ''ঈশ্বর সবাইকে সব কিছু দেন না। আমাকে অনেক কিছু দিয়েছেন। কিন্তু বড় ম্যাচে হ্যাটট্রিক আমার জন্য ছিল না। ওটা ভাইচুংয়ের জন্যই তোলা ছিল। সেদিন যে কী হয়ে গেল! পেনাল্টিটা মিস করে বসলাম।''
কাট টু ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫। শিল্ড ফাইনাল। মোহনবাগানকে সেদিন পাঁচ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল ইস্টবেঙ্গল। শ্যাম থাপা করেছিলেন দু'টি গোল। ঘটনাক্রমে আজ শনিবার আরও একটা শিল্ড ফাইনাল। আরও একটা ডার্বি। শহরের সব রাজপথ এসে মিশবে যুবভারতীতে।
আরও পড়ুন: ডার্বিতে মাঠ ভরাবে সমর্থকরা, ফ্যান্স ক্লাবের সঙ্গে আলোচনার পর দাবি বাগান কর্তাদের...
শ্যাম থাপা নস্ট্যালজিক। ফিরে যাচ্ছেন তাঁর সময়ের সেই বিখ্যাত ম্যাচে। বলছেন, ''সেদিন পেনাল্টি মিস না করলে আমার হ্যাটট্রিক হয়ে যায়।'' কথা শুনে মনে হচ্ছিল, সেই কাঁটা এখনও বিঁধে রয়েছে তাঁর মননে। ক্ষতে এখনও প্রলেপ পড়েনি।
এদিকে যে পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গিয়েছে সেই মহাম্যাচের। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে ৫-০ গোলে হারানোর রেকর্ড আজও উজ্জ্বল। বাঙালির জীবনে অর্ধশতক পেরিয়ে গেলেও যা এখনও অক্ষত। শ্যাম থাপাকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি যেন এখনই খেলে উঠেছেন সেই বড় ম্যাচ। নিজের খেলা নিজেই কাটাছেঁড়া করতে বসে গিয়েছেন। কিংবদন্তি বলছেন, ''পেনাল্টি থেকে আমি গোল করতাম। ভারতের হয়ে খেলার সময়ে আমিই পেনাল্টি নিতাম। প্রদীপদা আমাকে ডেকে ডেকে পেনাল্টি নিতে বলতেন। আর সেদিন আমি গোল করতে পারলাম না?''

তার পর নিজেই ব্যাখ্যা করে শ্যাম থাপা বলছেন, '' গোলকিপারের মুভমেন্ট দেখে আমি সাধারণত পুশ করতাম। জোরে মারতাম না। কিন্তু সেদিন যে কী হল! জোশের মাথায় জোরে মারলাম। বলটা উড়ে গেল।''
পঁচাত্তরের সেই ফাইনালের পর কোচ পিকে স্নেহ চুম্বন করেছিলেন শ্যাম থাপাকে। সেই ছবি এখনও সার্চইঞ্জিনে পাওয়া যায়। পেনাল্টি নষ্টের জন্য পিকে সেদিন মৃদু ভর্ৎসনাও করেন কিংবদন্তিকে। স্মৃতির পাতা উল্টে যান শ্যাম, ''প্রদীপদা আমাকে বলেছিলেন, পেনাল্টি নষ্ট না করলে বড় ম্যাচে তোমার হ্যাটট্রিক হয়ে যায় শ্যাম। কী করলে তুমি?''
পড়ন্ত বিকেলে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে শ্যামের। তিনি ফিরে যান পঁচাত্তরের শিল্ড ফাইনালে। বলেন, ''পেনাল্টি নষ্টের পরে সুব্রত আমার গাল টিপে দিয়েছিল। আমার খুব রাগ হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, তোমাকে আমি গোল দেব। দেখে নিও।''
রেফারির শেষ বাঁশির পরে ইস্টবেঙ্গলের সোনার ছেলেরা বীরের মর্যাদা পান। রাত দুটোয় বাড়ি ফিরেছিলেন মহানায়ক। হাসতে হাসতে তিনি বলছেন, ''সে আরেক স্টোরি। বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। খেলার আগে প্রদীপদা বলেছিলেন জিততে না পারলে সাপোর্টাররা তোমাদের গঙ্গায় ছুড়ে ফেলে দেবে, এটা মনে রেখো।''

এহেন শ্যাম থাপা মোহনবাগান জার্সিতেও রূপকথা লিখে গিয়েছেন। পেলে-ম্যাচে তিনি গোল করেছেন। আবার সবুজ-মেরুন জার্সিতে স্টপার পজিশনে খেলেও ট্রফি জিতেছেন। গোল করার পরের উদযাপনের ছবি সাজানো রয়েছে ড্রয়িং রুমের দেওয়ালে। শ্যাম থাপা সেই দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন, ''দেখেছেন কতটা লাফিয়ে ছিলাম।''
পছন্দের অভিনেতা রাজেশ খান্না। মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে আলাপচারিতার ছবিও ফ্রেমবন্দি হয়ে রয়েছে শো কেসে। রয়েছে অক্ষয় কুমার আর শ্যাম থাপার ছবিও। এখনকার ডার্বি দেখতে বসে কিংবদন্তি শ্যাম কি নিজেকে খোঁজেন মাঠে? কিংবদন্তি বলছেন, ''এভাবে তুলনা হয় না। শ্যাম থাপার সময়ে শ্যাম থাপা হিরো ছিল। পরে অন্যরা এসেছে। কখনও কৃশানু দে, কখনও অন্য কেউ। সিনেমায় যেমন হয়, কখনও দিলীপ কুমার, কখনও রাজেশ খান্না...কখনও আবার অমিতাভ বচ্চন। এখন সময় বদলে গিয়েছে। নতুন হিরো এসেছে। ওভাবে তুলনা করলে চলবে না।''
শনি-সন্ধ্যার ডার্বি কার? ইস্ট না মোহনের? শ্যাম থাপা উত্তর দেন না। ঠিক যেমন বল পায়ে তিন-চার জনকে অবলীলায় ড্রিবল করে বেরিয়ে যেতেন, সেরকম ভঙ্গিতেই বলছেন, ''ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান--দুটো ক্লাবেই আমি খেলেছি। দুটোই আমার ক্লাব। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে বহু ম্যাচ খেলেছি। মোহনবাগানের হয়েও তাই। আমি বলব না কে জিতবে, কে হারবে। আমি খালি বলব আজকের ম্যাচ ভাল হোক। কড়া টক্কর হোক। সবাই ম্যাচ উপভোগ করুক।''

কত শত ম্যাচ খেলেছেন তিনি। কত গোল করেছেন। কলকাতা ময়দানের সবুজ ঘাসে লেখা রয়েছে শ্যাম থাপার সোনালী আখ্যান। গড়ের মাঠ থেকে এখনও ভেসে আসে ছড়ার লাইন, —'উলগা নাচে, হাবিব নাচে, সুব্রত বাজায় ঢোল, অরুণ ঘোষ চেয়ে দ্যাখে শ্যাম থাপার গোল।''
মুখে মুখে রচিত যে কবিতা পরবর্তীতে বদলে গিয়েছে অনেকটাই। কিন্তু আদিঅনন্ত কাল ধরে মিথ হয়ে থেকে গিয়েছে শ্যাম থাপার গোল। বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে থেকে গিয়েছেন কিংবদন্তি।
আরও পড়ুন: এই রেকর্ড নেই শচীন বা বিরাটেরও, যা করে দেখালেন এই ২৪ বছরের তরুণ
