অর্ণব মণ্ডল: ভারতীয় ফুটবল ঘিরে এখন অনিশ্চয়তা আর অনিশ্চয়তা। ইতিবাচক কোনও খবর নেই। প্রতিদিন সকালে সংবাদপত্রের পাতায় দেশের ফুটবলের অধোঃগতি পড়তে কাঁহাতক ভাল লাগে। এর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে সর্বোচ্চ লিগ ঘিরে প্রশ্ন আর প্রশ্ন। প্রায় বন্ধ হতে চলার উপক্রম হয়েছে আইএসএল। লিগের বল কবে গড়াচ্ছে, কেউ জানেন না! এই সব খবর পড়ে বলতে ইচ্ছা করে, '' এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার।''
এই অন্ধকারময় পরিস্থিতি তৈরি হল কেন আমার দেশের ফুটবলে? যাঁরা এদেশের ফুটবলের মস্তিষ্ক, গোটা দেশে খেলাটা পরিচালনা করেন, তাঁরা কি জানেন না, পা থেকে বল চলে গেলে কতটা কষ্ট হয় ফুটবলারদের? সেই সব কর্তারা কি হৃদয় হারিয়েছেন? বিন্দুমাত্র অনুভব করতে পারেন খেলোয়াড়দের মানসিক অবস্থাটা?
সোজা উত্তর, পারেন না। অনুভূতি হারিয়েছেন তাঁরা। যদি অনুভূতিসম্পন্ন হতেন, ফুটবলারদের মনের খোঁজখবর রাখতেন, তাহলে আজ এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতেই হতো না আমাদের ফুটবলকে। দেশের শ্বাসপ্রশ্বাসে ভয়-ভীতি, আশঙ্কা, দুঃশ্চিন্তা, প্রশ্ন।

এই অনিশ্চয়তার বাতাবরণে ভাল কিছু করা সম্ভব নয়। ভারতীয় ফুটবল তার জ্বলন্ত উদাহরণ। খালি পিছু হাঁটছে। জাতীয় দল পারছে না দেশের ও বিদেশের মাটিতে। মুখ থুবড়ে পড়ছে। এএফসি এশিয়ান কোয়ালিফায়ারে ডাহা ফেল। বেরিয়ে পড়ছে হাড় জিরজিরে কঙ্কালসার চেহারাটা।
অবশ্য এমন যে হতে চলেছে তার আঁচ পাওয়া গিয়েছিল ইগর স্টিমাচের সময় থেকেই। দেশের ফুটবলের দিন বদলের শপথ করেই তো কয়েকজন রিমোট কন্ট্রোল হাতে তুলে নিয়েছিলেন। নতুন দিশা দেখানোর মন্ত্র নিয়েই তো তাঁরা মাভৈঃ বলে নেমে পড়েছিলেন। আমরাও ভেবেছিলাম, আমার দেশের ফুটবলের ছবিটা এবার বদলাতে চলেছে। কিন্তু এত করুণ পরিণতি যে হবে, তা ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি।
তবে কি তাঁরা কেবল ক্ষমতা-গদির লোভেই ফুটবলের রাজ্যপাট চালানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন? সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। নতুন দিনের আলো দেখার পরিবর্তে ভারতীয় ফুটবলে এখন আলোর অভাব। অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে।
জাতীয় দলের ফুটবলাররা ম্যাচ পায় না। ম্যাচ না হওয়ায় ফিটনেস কম। কাগজপত্রে যা দেখি, জাতীয় দল গোছাতেই ঘেমে নেয়ে একসা। এই ক্লাব খেলোয়াড় ছাড়ে না। ওই ক্লাব খেলোয়াড় ধরে রাখে। অনুরোধ উপরোধ করেও কাজ হয় না। এশীয় পর্যায়ের যোগ্যতা পর্বে অংশ নিতে গিয়ে অগোছালো ছবিটা প্রকট হয়ে ধরা দিল।

ম্যাচের অভাবের কথা আগেই বলছিলাম। ঠিক মতো ম্যাচ না পাওয়ায় গত পাঁচ বছরে অনেককেই তো হারিয়ে যেতে দেখলাম। ফুটবল ক্যালেন্ডার ঠিক নেই। কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না। কেমন একটা গয়ং গচ্ছ ভাব। কীভাবে চলবে,আগামী প্রজন্মের ফুটবলাররা কী পাবে, ভারতীয় ফুটবলের কী হবে, তা নিয়ে কারও চিন্তাভাবনা নেই। দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিতদের মধ্যে দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো আচরণ।
দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ লিগ নিয়ে অনিশ্চয়তার যে ছবি দেখছি, তাতে বোঝা যাচ্ছে পরিচালন গোষ্ঠীর ঝুলিতে নেই পরিকল্পনা, নেই দূরদৃষ্টি। নেই-নেই-এর পৃথিবীর যেন বাসিন্দা তাঁরা। এফএসডিএলের সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়ে আসছে, এই খবর তো কবে থেকেই আমি জানি। তবুও তা নিয়ে আগে থেকে কেন চিন্তাভাবনা করা হল না? কেন মরণকালে হরির নাম হবে? প্ল্যান এ বিফলে গেলে প্ল্যান বি আগে থেকে কেন ঠিক করা হল না? এখন কোর্ট-কাছারি, শেয়ার দেওয়া নিয়ে 'দড়ি টানাটানি' করে কী হবে?
তাঁদের এই চুক্তির উপরে ভিত্তি করে প্লেয়ারদের সংসার চলে। ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। যাঁরা চেয়ারে বসে আছেন তাঁরা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করার ক্ষমতা হারিয়েছেন? সমাধান সূত্র বের করার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছেন না? সেটাই যদি হয়, তাহলে বলতে বাধ্য হচ্ছি, তাঁদের সরে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের লিগ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কেউ কস্মিনকালেও কি বুঝতে পেরেছিলেন এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হবে?
তেনারা বলছেন, সময় লাগবে। কত সময়? কবে কিক অফ হবে, নির্দিষ্ট করে কি বলা সম্ভব? ফুটবলাররা আর কত দিন অপেক্ষা করবে? ফ্র্যাঞ্চাইজিরা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢেলে বসে রয়েছে। অনন্ত অপেক্ষা তো তারাও করতে পারবে না।
মানুষের আবেগ নিয়ে খেলা কি ঠিক? দেশের ফুটবল নিয়েও এই তামাশার কোনও দরকারই ছিল না। অত্যন্ত শ্রদ্ধা সহকারেই বলছি, খালিদ জামিলকে জাতীয় দলের হেড কোচের চেয়ারে বসানো সঠিক সিদ্ধান্ত নয়।
কাফা নেশনস কাপের সাফল্যে চোখ ধাঁধিয়ে গেলে চলবে না। নেশনস কাপে অনেক দলই নিজেদের প্রথম সারির দল নামায়নি। কাফার সাফল্যের নটেগাছ মুড়োতে কত দিন লাগল?
এএফসি এশিয়ান কাপ কোয়ালিফায়ার থেকেই তো পত্রপাঠ বিদায় নিতে হল ভারতকে। সামনে বাংলাদেশের সঙ্গে খেলা। সেই ম্যাচের ফলাফল অন্যরকম কিছু হলে ক্ষতি কার? ভাবমূর্তি নষ্ট হবে কাদের? ভাবুন, ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিস করুন এখন থেকেই।
খালিদ জামিল পার্ট টাইম হিসেবে ঠিক আছে। কিন্তু হেড কোচ--নৈব নৈব চ। ভাল মানের কোচ আনতে হলে যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক দিতে হবে। সেই অর্থ দেওয়ার ক্ষমতা নেই আমাদের।
আইএসএল কবে শুরু, কবে শেষ, তা দেবা ন জানন্তি। পুরো ব্যাপারটাই জগাখিচুরি হয়ে রয়েছে।
নতুন প্রজন্মের কাছে কী বার্তা পৌঁছাচ্ছে বলুন তো? অভিভাবকরা দেখছেন, ভারতের সেরা লিগ বন্ধ হয়ে রয়েছে। কবে শুরু হবে কেউ জানেন না। তাহলে সেই অভিভাবকরা বাচ্চাদের ফুটবল মাঠে আর পাঠাবেন কেন!
হঠাৎ করে সুপার কাপ হচ্ছে? কবে একটা ডুরান্ড কাপ হল, তার পরে আর খেলা নেই। সুপার কাপের নক আউট পর্বের পরে কী আছে কেউ জানেন না। ফুটবলাররা বসে রয়েছেন দিনের পর দিন। ক্লাবগুলো অনুশীলন বন্ধ করে দিচ্ছে। জটের পর জট পাকাচ্ছে। জল খুলতে তো দেখছি না।
ফুটবল একটা শিল্প। এতদিনেও আমার দেশে ফুটবল ইন্ডাস্ট্রি হয়ে উঠতে পারল না। অথচ ক্রিকেট কিন্তু লাভজনক শিল্পে পরিণত হয়েছে সেই কবেই। ঘরে ঘরে বিরাট কোহলির ছবি, রোহিত শর্মার কাট আউট। এখানেই ক্রিকেটের বাহাদুরি। ক্রিকেটের কাছে ফুটবল অনেক আগেই দশ গোল খেয়ে বসে রয়েছে।
দেশের ক্রিকেট নিয়ে বলার অনেককিছু রয়েছে। রিন্তু ফুটবল নিয়ে বলার মতো কিছুই নেই। সব দিক থেকেই দম বন্ধ করা এক পরিস্থিতি।
সবুজ ঘাসের মাঠে ফের শুরু হোক ফুটবল। গ্যালারি ভরাক সমর্থকরা। ফুটবলারদের পায়ে ঘোরাফেরা করুক ফুটবল। আকাশবাতাস বিদীর্ণ করে উঠুক সেই গগনভেদী চিৎকার, গো-ও-ও-ল।
ফুটবল আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি। দয়া করে, সেই শান্তি কেড়ে নেবেন না। ফুটবল নিয়ে বাঁচতে দিন আমাকে। বাঁচতে দিন আমার দেশের ফুটবলারদেরও। প্লিজ, ওদের পা থেকে বল কাড়বেন না।
