কৃশানু মজুমদার: ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাস্টারের সামনে জীবনের প্রথম ডার্বি ম্যাচ। খেলেছেন কলকাতার দুই প্রধানেও। এখন পিছন ফিরে নিজের ফুটবল জীবনের দিকে তাকালে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। অস্ফুটে বলে যান, ''আরেকটু খেলতেই পারতাম।''
তিনি শোভন চক্রবর্তী। এই প্রতিবেদকের কাছে নিজের ফুটবলজীবনের ঝাঁপি খুলে প্রাক্তন ফুটবলার বলছেন, ''ভাল চাকরি পেতে পারতাম। রেলের চাকরি পাকা ছিল। চাকরিতে না গিয়ে চলে গেলাম ইস্টবেঙ্গলের অনুশীলনে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ইন্টারভিউ দেওয়ার পরেও কোনও এক অজ্ঞাত কারণে চাকরিটা আর হল না।'' ভারী হয়ে যায় শোভনের গলা। অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না।
আরও পড়ুন: ইরফানের বিস্ফোরণ, ধোনির হুকা মিম ছড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়
প্রতিশ্রুতি জাগিয়ে টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমি থেকে ইস্টবেঙ্গলে এসেছিলেন। লেসলি ক্লডিয়াস সরণীর ক্লাবের রিমোট কন্ট্রোল তখন ছিল কার্লোস পেরেরার হাতে। ব্রাজিলীয় কোচের নোটবুকে উঠে গিয়েছিল তাঁর নাম। বঙ্গতনয়কে স্নেহ করতেন বর্ষীয়ান কোচ। মালা গাঁথতে বসেন শোভন। হয়ে পড়েন নস্ট্যালজিক।

২০০৭-এর বাংলা নববর্ষের দিন কলকাতা হয়ে উঠেছিল তিলোত্তমা। তৎকালীন ফিফা প্রেসিডেন্ট ব্লাটার ও এএফসি-র সভাপতি বিন হামামের সামনেই যুবভারতীতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইস্ট-মোহনের বড় ম্যাচ। বারুদে ঠাসা সেই ম্যাচে পরিবর্ত হিসেবে নেমেছিলেন শোভন। সেটাই ছিল তাঁর জীবনের প্রথম বড় ম্যাচ।
ডায়রির ছেঁড়া পাতা উল্টে শোভন বলছেন,''আমি ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ছিলাম। চন্দন দাসের পরিবর্তে আমাকে নামিয়েছিলেন কার্লোস।'' প্রথম ডার্বির স্মৃতি ভাল নয় শোভনের। মোহনবাগানের কাছে ম্যাচটা হারতে হয়েছিল ইস্টবেঙ্গলকে। সেই ম্যাচের গোলদাতারা ছিলেন সবাই ব্রাজিলীয়। মোহনবাগানের হয়ে ব্যারেটো ও ডগলাস গোল করেন। লাল-হলুদের গোলদাতা ছিলেন এডমিলসন।
আজ ব্যারেটোর জন্মদিন। মোহনবাগান সুপারজায়ান্টের সোশ্যাল মিডিয়া পেজে লেখা হয়েছে, ''শুভ জন্মদিন স্বপ্নের জাদুকর, আমাদের সবুজ তোতা, আমাদের প্রিয় - জোসে রামিরেজ ব্যারেটো।''

একসময়ে ব্রাজিলীয়র সঙ্গে রুম শেয়ার করেছেন। ব্যারেটোর স্নেহের পাত্র হয়ে উঠেছিলেন ভবানীপুরে খেলার সময়ে। ভবানীপুরের জার্সিতেই কলকাতা লিগের সবথেকে ধারাবাহিক প্লেয়ার বিবেচিত হয়েছিলেন তিনি। টানা তিনটি ম্যাচে সেরা খেলোয়াড়ের সম্মান পেয়েছিলেন।
ভবানীপুরে খেলার সময়ে ব্রাজিলীয় কোচ জুলিয়ানোর কাছ থেকে পেয়েছিলেন বাহবা। সেটা হয়তো তাঁর জীবনের সঞ্চয়। শোভন বলে চলেন, ''মোহনবাগানের বিরুদ্ধে আমাদের ম্যাচ ছিল। ক্লাসে জুলিয়ানো স্যর বলছিলেন, মোহনবাগানের আসল খেলোয়াড় কাটসুমি। ওকে কে মার্কিং করবে?''
কোচের প্রশ্নের উত্তরে সবাই চুপ করেছিলেন। জুলিয়ানো তখন শোভনকে জিজ্ঞাসা করেন, ''তুমি পারবে কাটসুমিকে থামাতে?'' স্মৃতির পাতা ওল্টান শোভন, ''আমি চুপ করেছিলাম। জুলিয়ানো স্যর তখন বিরক্তি প্রকাশ করেন। আমি বলি, ঠিক আছে কাটসুমিকে আমি মার্কিং করবো।''
ম্যাচে কাটসুমিকে নিষ্প্রভ করে দেন বাঙালি ফুটবলার। ভাল খেলেও সেই ম্যাচে হার মেনেছিল ভবানীপুর। জুলিয়ানোর কাছ থেকেই পেয়েছিলেন বড় সার্টিফিকেট। শোভনের স্মৃতিচারণ, ''আমরা তখন ইডেন গার্ডেন্সে জিম করতাম। জুলিয়ানো স্যর বলেছিলেন, তুমি মেহতাবের থেকেও বড় ফুটবলার। এরকম অনেক কোচই আমাকে ভাল বলেছিলেন। অনেক ভাল কথা শুনেছি। কিন্তু... ।''
কথা আর শেষ করেন না সোদপুরের প্রাক্তন ফুটবলার। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা হয়তো তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করে। শোভন বলে চলেন, ''ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মহমেডান স্পোর্টিংয়ে যাওয়ার পরে কোচ সাবির আলি প্রথম কয়েকটা ম্যাচে আমাকে সুযোগ দেননি। কর্তারা আমার কথা বলেছিলেন ঠিকই কিন্তু সাবিরদার আমার প্রতি আস্থা হয়তো ছিল না।''
কথায় বলে, লাইফ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। কল্পকাহিনির থেকেও বড় অদ্ভুত এই জীবন। কোন মোড়ে যে কী লুকিয়ে রয়েছে, কেউ জানেন না। শোভন বলেন, ''পরিষ্কার মনে রয়েছে দিনটা। পিয়ারলেসের সঙ্গে মহমেডানের ম্যাচ। আগের চারটে ম্যাচে ওয়ার্ম আপ করিয়েও সাবির আলি আমাকে নামাননি। ম্যাচের দিন উল্টোডাঙ্গা থেকে যুবভারতী যাচ্ছি অটোতে। সাবিরদা ফোন করে বললেন, তোমাকে আজ খেলতে হবে। ভাল খেলতে পারলে ঠিক আছে, নইলে...।''

ম্যাচের কয়েক ঘণ্টাও আগেও জানতেন না তিনি প্রথম একাদশে রয়েছেন। সেদিন ম্যাচের সেরা হয়েছিলেন। সাদা-কালো জার্সিতে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি শোভনকে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন মহমেডানের অকুলের কুল, অগতির গতি, অনাথের নাথ। শোভন বলে চলেন, ''মহমেডানে খেলার সময়ে চোটআঘাত ছাড়া আমার জায়গা কেউ কাড়তে পারেনি। জেসিটির বিরুদ্ধে ম্যাচে বলজিৎ সিং সাইনি আমার পা মাড়িয়ে দিয়েছিল। যন্ত্রণায় খেলতে পারছিলাম না। তবুও সাবিরদা বলছিলেন, তোমাকে খেলতে হবে।''
চোটের লাল চোখ দেখে সবুজ ঘাসের মাঠ থেকে বিদায় নিতে হয় ছিপছিপে চেহারার শোভনকে। সাদার্ন সমিতির হয়ে খেলার সময়ে টানা তিন দিন অনুশীলনে চোট পেলেন। লজ্জায় কাউকে কিছু না বলে নীরবে নিভৃতে বেরিয়ে আসেন মাঠ ছেড়ে। তার আগে সাদার্ন কর্তা সৌরভ পাল তাঁকে ধরেই দল সাজিয়েছিলেন। অগ্রিম পেমেন্টও নিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু খেলতে না পারায় সেই টাকা ফেরত দিয়ে দিতে হয়। তার পরেও চোট সারিয়ে মাঠে ফেরার চেষ্টা করেন। কিন্তু ফুটবল নিয়ে আর এগোতে পারেননি।

বছর চারেক চাকরি করছেন। সুখ-দুঃখের স্মৃতিরা ভিড় করে তাঁর চোখে। শোভন বলেন, ''অনেক বড় প্লেয়ারের সঙ্গে রুম শেয়ার করেছি। দুই প্রধানে খেলেছি। একাধিক ক্লাবের প্রস্তাব পেয়েছিলাম। এগুলো সুখস্মৃতি। তবে আফশোসও রয়েছে, আরেকটু খেলতেই পারতাম। আরও ভাল চাকরিও হয়তো পেতাম।''
কী হতে পারতাম, এটাই নাকি মানুষের জীবনের সব থেকে বড় ট্র্যাজেডি। শোভন চক্রবর্তীর উপলব্ধিও কি তাই? জবাব দেন না প্রাক্তন ফুটবলার। নীরবতা হয়তো সম্মতিরই লক্ষ্মণ।
আরও পড়ুন: বিবিএলে পা রাখবেন অশ্বিন? জেনে নিন তারকা স্পিনার কী বলছেন
