প্রিয় গম্ভীর,
আজ আপনি ভারতীয় ক্রিকেট দলের হেড কোচ। দেশের কোটি কোটি ক্রিকেটপ্রেমী আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন — কেউ আশায়, কেউ প্রশ্নে।
আপনাকে তাঁরা মনে রেখেছেন একজন যোদ্ধা হিসেবে, যিনি নিজের জীবনে অন্যায়ের স্বাদ পেয়েছেন, তাই ভেবেছিলেন — আপনি জানেন ন্যায়ের আসল মানে কী। কিন্তু আজ সেই ন্যায়ের প্রশ্নটাই আবার উঠছে — রোহিত শর্মাকে ঘিরে।

আইসিসি ওডিআই র‍্যাঙ্কিংয়ে রোহিত বর্তমানে বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটার। তাঁর নেতৃত্বে ভারত গত কয়েক বছরে জিতেছে একাধিক বড় টুর্নামেন্ট ও সিরিজ। তবুও, এমন একজন অধিনায়ককে নিয়ে যদি আজ দলে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়,তাহলে প্রশ্ন উঠবে — ভারতীয় ক্রিকেটে সিদ্ধান্ত কি সত্যিই ফর্মের উপর নির্ভর করছে,নাকি অন্য কিছুর উপর?

যিনি দলটাকে মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে দুটো আইসিসি শিরোপা এনে দিয়েছেন। ২০১৩-র পরে আবার আপামর ক্রিকেটপ্রেমীরা বিশ্বজয়ের স্বাদ পেয়েছেন। আজ সেই মানুষটাই যদি নির্বাচনের টেবিলে সন্দেহের মুখে পড়েন, তাহলে বুঝে নিতে হবে, ভারতীয় ক্রিকেটে সাফল্য আর সুরক্ষা এক নয়। 

এটা কেবল এক অধিনায়ককে বাদ দেওয়া নয়,এটা যেন নিজেরই অর্জনের ইতিহাসকে ছেঁটে ফেলার চেষ্টা,যেন কেউ চাইছে, রোহিতের নেতৃত্বের ছায়াটা যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ধরা না দেয়। 

নির্বাচক কমিটির দিকেও দৃষ্টি নিক্ষেপ করা উচিত। বর্তমান নির্বাচকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান অজিত আগরকর এমন এক ক্রিকেটার, যিনি একসময়ে অস্ট্রেলিয়ায় টানা ছয় ইনিংসে শূন্য করেছিলেন। আজ তিনিই রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলির মতো কিংবদন্তিদের ভবিষ্যৎ ঠিক করছেন! 

আর গম্ভীর, আপনি চুপ। যেমন একসময় আপনার বিষয়ে চুপ ছিল অন্যরা। এটাই কি ভাগ্যের পরিহাস নয়? 

যে মানুষ একসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, আজ সেই একই অন্যায়ের সামনে মুখ বন্ধ রেখেছেন।
যে নীতির নামে আপনাকে একদিন অবহেলা করা হয়েছিল, আজ সেই নীতির নামেই রোহিত শর্মাকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ইতিহাস যেন কেবল পুনরাবৃত্তি নয়, এবার একধরনের বিনোদন হয়ে উঠেছে। শুধু চরিত্র বদলে গেছে। সংলাপগুলো রয়ে গেছে আগের মতোই।

গম্ভীর, আপনি কি সেই মানুষই আছেন, যিনি ২০১১ সালে মাথা উঁচু করে দেশকে ফাইনালে জয় এনে দিয়েছিলেন? নাকি এখন সেই মাথা নিচু করে রাখাই আপনার 'কৌশল'?
যে মানুষ একসময়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যাট চালিয়েছিলেন, অবলীলায় বলেছিলেন, “এক ছক্কে নে ওয়ার্ল্ডকাপ নেহি জিতায়া”,আজ তিনিই কি অন্যায়ের পক্ষে কলম নামিয়ে রাখছেন?
এটাই কি সেই নীরবতা, যা একসময় আপনাকেও কষ্ট দিয়েছিল? যখন আপনাকে, একজন বড় ম্যাচ প্লেয়ারকে, 'নীতির নামে' একের পর এক উপেক্ষা করা হয়েছিল?
আপনি তো জানেন, নীরবতা কোনওদিন নিরপেক্ষ থাকে না। সে নিজেই একধরনের অবস্থান হয়ে দাঁড়ায়।
আজ আপনি চুপ থাকলে, ইতিহাস ভাববে —
আপনার এই নীরবতাই হয়তো সেই অন্যায়ের স্বীকৃতি। 

২রা এপ্রিলের রাতে ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলে আপনি যখন মাথা উঁচু করে ড্রেসিংরুমে ফিরছিলেন,তখন পুরো দেশ আপনাকে দেখেছিল — এক অবিচল মুখ, এক যোদ্ধার অবয়ব। 

আজ সেই মুখটাই যেন সময়ের রাজনীতিতে কোথাও হারিয়ে গেছে। আপনি তো জানেন, এই খেলা কেবল ২২ গজের নয়, এটা নীতির, সাহসের, আর সংযমের খেলা।

আপনি নিজেই দেখেছেন কত প্রতিভা সময়ের ফাঁকে হারিয়ে যায় —কেউ নীতির নামে, কেউ রাজনীতির নামে। আপনি তাদেরই একজন ছিলেন। তাই আজ মানুষ আশা করেছিল —আপনি সেই চক্রটা ভাঙবেন।

রোহিত শর্মাকে অধিনায়কত্ব থেকে ছেঁটে ফেলা এবং ২০২৭-এর বিশ্বকাপ দলে অনিশ্চিত করে তোলার অর্থ কেবল একজন যোগ্য ক্রিকেটার নয়, ভারতীয় ক্রিকেটের বিবেককেই বাদ দেওয়া। রোহিত শর্মা কোনও নাম নয়, কোনও সংখ্যা নয়।

তিনি এক দর্শন, এক মানসিকতা। যেখানে নেতৃত্ব মানে নিজের আগে দলের নাম লেখা। রোহিতের নেতৃত্বে ভারতের জয় এসেছে কেবল মাঠে নয়, মনেও। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে ঠাণ্ডা মাথায় যুদ্ধ জেতা যায়। তাঁকে বাদ দেওয়ার মানে কেবল একজন ওপেনারকে হারানো নয়,একটা দর্শন, একটা যুগ, একটা চিন্তাধারাকে অস্বীকার করা।

সময় কাউকে ছাড়ে না, আপনি জানেন। সব দেখে রাখে — কে চুপ ছিল, কে বলেছিল, কে নিজের অবস্থান বাঁচাতে সত্যের পাশে দাঁড়ায়নি।

আজ আপনি যদি চুপ থাকেন, কাল কেউ না কেউ নিশ্চয়ই আপনাকেও প্রশ্ন করবে, “গম্ভীর, আপনি কি নিজের ক্ষমতার প্রতি সুবিচার করতে পেরেছিলেন?” আর ইতিহাস খুব শান্ত গলায় বলবে, “না, তিনি পারেননি।”

রোহিতের সময় হয়তো কেটে যাবে, কিন্তু আপনি? আপনি এখনও সময়ের কোচিং বক্সে দাঁড়িয়ে আছেন।
একটা সিদ্ধান্তেই বদলে দিতে পারেন ভবিষ্যতের অধ্যায়।

আপনি চাইলে প্রমাণ করতে পারেন, ভারতীয় ক্রিকেট কেবল ট্রফি দিয়ে নয়, নৈতিক সাহস দিয়েও বিচার হয়।

আপনি তো জানেন, সাহসের আসল পরীক্ষা হয় সিলেকশন মিটিংয়ের ঘরে, যেখানে কেউ মুখ খোলে না, কিন্তু সবার চোখে একটাই প্রশ্ন থাকে,
“রোহিতকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত কে নিচ্ছে?”

আপনি যদি সেই মুহূর্তে নীরব থাকেন,তাহলে আপনার আগের সব সাহসই ম্লান হয়ে যাবে।

আপনি যদি সত্যিই সেই মানুষ হন, যিনি দেশের জন্য ৯৭ রানে থেমেও মাথা উঁচু রেখেছিলেন,
তাহলে আজও মাথা উঁচু করে বলুন, “দল গঠনের সময় ন্যায়ের প্রতি সুবিচার চাই।”

কারণ রোহিতকে বাদ দেওয়া মানে শুধু একজন ব্যাটসম্যান নয়, একটি সফল দর্শন, একটি সাফল্যের মনোভাবকেও বাদ দেওয়া।

আজ ইতিহাস আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, গম্ভীর। এক হাতে “ইগো”, অন্য হাতে “অভিজ্ঞতা”।
আপনি কাকে বেছে নেবেন, সেটাই ঠিক করবে —আপনি সময়ের কোন পাশে দাঁড়ালেন।

কারণ সময়ওয়ালা খুব নির্দয়। ও কোনও মুখ চেনে না, কোনো পদে নমস্কার করে না। ও শুধু মনে রাখে, কে সাহস করেছিল, আর কে চুপ ছিল। সিদ্ধান্ত আপনার — ইগোর পাশে দাঁড়াবেন, নাকি অভিজ্ঞতার?

কারণ ইতিহাস বড় নির্মম। সে বিচারও করে। আর হয়তো একদিন কেউ আপনাকেও প্রশ্ন করবে —“গম্ভীর, আপনি কি নিজের সাহসের প্রতি সুবিচার করতে পেরেছিলেন?”

ইতি 

দেশের ক্রিকেটের একনিষ্ঠ ভক্ত 
সৈকত মুখার্জি