আজকাল ওয়েবডেস্ক: মোবাইলে অ্যালার্মের কর্কশ শব্দ। চোখ না খুলেই হাতটা বাড়িয়ে দিলেন ফোনটার দিকে। ‘স্নুজ’ বোতামটা টিপে আরও দশ মিনিটের সাময়িক শান্তি। এই দৃশ্যটা প্রায় প্রতিটা বাড়ির, প্রতিটা মানুষের। রাতে পছন্দের ওয়েব সিরিজ দেখতে দেখতে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরতে ঘুরতে কখন যে দু’টো বেজে যায়, তার হিসেব থাকে না। অথচ সকালে ঘণ্টাখানেক আগে ওঠার চেষ্টা যেন এক অসম যুদ্ধ। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন, দেরি করে ঘুমোতে যাওয়ার চেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠাটা এত বেশি কঠিন কেন? এর নেপথ্যে রয়েছে আমাদের শরীর ও মনের এক জটিল রসায়ন।
বিষয়টি বুঝতে হলে প্রথমেই জানতে হবে দেহের নিজস্ব ঘড়ি বা ‘সার্কাডিয়ান রিদম’-এর কথা। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, আমাদের মস্তিষ্ক একটি প্রাকৃতিক ২৪ ঘণ্টার চক্র মেনে চলে, যা আমাদের ঘুম এবং জাগরণের সময়কে নিয়ন্ত্রণ করে। যখন আমরা প্রতিদিন দেরি করে ঘুমাতে যাই, তখন এই দেহ-ঘড়িটিও ধীরে ধীরে পিছিয়ে যায়। ফলে, আমাদের মস্তিষ্ক ধরে নেয় যে রাত দু’টো বা তিনটেই আমাদের ঘুমানোর স্বাভাবিক সময়। তাই ভোর ছ'টায় অ্যালার্ম বাজলে শরীর বিদ্রোহ করে, কারণ তার অভ্যন্তরীণ ঘড়ির মতে সেটা তখনও গভীর ঘুমের সময়।
দ্বিতীয় কারণটি হল হরমোনের খেলা। আমাদের ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে মেলাটোনিন নামক একটি হরমোন, যা অন্ধকার নামলে নিঃসৃত হতে শুরু করে এবং আমাদের ঘুমিয়ে পড়তে সাহায্য করে। অন্যদিকে, কর্টিসল নামক হরমোন সকালে আমাদের জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। যখন আমরা গভীর রাত পর্যন্ত উজ্জ্বল স্ক্রিনের (মোবাইল, ল্যাপটপ) দিকে তাকিয়ে থাকি, তখন মেলাটোনিন নিঃসরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে ঘুম আসতে দেরি হয়। সকালে যখন অ্যালার্ম বাজে, তখনও মেলাটোনিনের প্রভাব শরীর থেকে পুরোপুরি কাটে না এবং কর্টিসলের ক্ষরণও ঠিকমতো শুরু হয় না। এই হরমোনের দড়ি টানাটানিতেই ঘুম ভাঙতে চায় না।
পাশাপাশি, ‘স্লিপ ইনার্শিয়া’ বা ঘুমের জড়তাও একটি বড় কারণ। ঘুম থেকে ওঠার পর প্রায় ১৫ থেকে ৩০ মিনিট পর্যন্ত আমাদের মস্তিষ্ক পুরোপুরি সজাগ হয় না। বিশেষ করে রাতের প্রথম ভাগের গভীর ঘুম বা ‘ডিপ স্লিপ’-এর সময় শরীর নিজেকে মেরামত করে। সেই চক্রের মাঝে অ্যালার্ম বেজে উঠলেও ‘স্লিপ ইনার্শিয়া’-র কারণে শরীর-মন আরও কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন থাকে।
আরও পড়ুন: মধুচক্র চালানোয় অভিযুক্ত অভিনেত্রী অনুষ্কা দাস! সেক্স র‍্যাকেট থেকে উদ্ধার বাংলা সিরিয়ালের আরও ২ নায়িকা! তুলকালাম মহারাষ্ট্রে 
শুধু এখানেই শেষ নয়, মনোবিদদের মতে, এর নেপথ্যে একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক কারণও রয়েছে, যাকে আজকাল ‘রিভেঞ্জ বেডটাইম প্রোকাস্টিনেশন’ বলা হচ্ছে। সারাদিন অফিস, পড়াশোনা বা সংসারের চাপে যাঁরা নিজেদের জন্য এতটুকু সময় পান না, তাঁরা ঘুমের সময় কমিয়ে তার ‘প্রতিশোধ’ নেন। রাতের এই সময়টুকুতেই তাঁরা নিজেদের পছন্দের কাজ করে স্বাধীনতা উপভোগ করতে চান। এই তাৎক্ষণিক আনন্দের মোহ কাটানো কঠিন। তুলনায়, সকালে ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে দায়িত্বের চিন্তা। মস্তিষ্ক স্বভাবতই সহজ এবং আনন্দের পথটি বেছে নিতে চায়।
মুক্তির উপায় কী?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই চক্র ভাঙা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন কয়েকটি অভ্যাস বদলানো।
প্রথমত, ছুটির দিন-সহ প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমোতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। এতে দেহঘড়ি ধীরে ধীরে সঠিক সময়ে ফিরে আসবে।
দ্বিতীয়ত, ঘুমানোর অন্তত এক ঘণ্টা আগে থেকে মোবাইল, ল্যাপটপ বা টিভি বন্ধ করে দিতে হবে। স্ক্রিনের নীল আলো মেলাটোনিন নিঃসরণে বাধা দেয়।
তৃতীয়ত, রাতের খাবার খাওয়ার পর চা বা কফি নৈব নৈব চ। ঘুমোতে যাওয়ার ঠিক আগে ভারী খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
চতুর্থত, সকালে ঘুম থেকে উঠেই ঘরের জানালা-দরজা খুলে দিন। ভোরের প্রাকৃতিক আলো কর্টিসল হরমোনকে সক্রিয় করে তোলে এবং শরীরকে সজাগ হতে সাহায্য করে।
সুতরাং, ভোরে ঘুম থেকে উঠতে না পারাটা শুধু ইচ্ছাশক্তির অভাব বা আলস্য নয়। এর পিছনে রয়েছে আমাদের পরিবর্তিত জীবনযাত্রা, প্রযুক্তি এবং জৈবিক প্রক্রিয়ার এক সম্মিলিত প্রভাব। যুদ্ধটা তাই অ্যালার্মের সঙ্গে নয়, বরং আমাদের অভ্যাস এবং দেহঘড়ির সঙ্গেই।