আজকাল ওয়েবডেস্ক: শহর জুড়ে এখন উৎসবের মেজাজ। দীপাবলির প্রাক্কালে ক্রমশ আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠছে রাতের শহর। তবে আধুনিকতার চাকচিক্য, এলইডি টুনি আর আতসবাজির দাপটে পুরনো রীতিগুলো যেন কিছুটা কোণঠাসা। কিন্তু এই আলোর সমারোহের মধ্যেও কোনও কোনও বাড়ির ছাদে বা উঠোনের এক কোণে লম্বা বাঁশের ডগায় আজও টিমটিম করে জ্বলে আকাশপ্রদীপ। সেই প্রদীপ যেন এক চিরন্তন বার্তা বহন করে চলেছে। এই আকাশপ্রদীপ জ্বালানোর তাৎপর্য কী? জানেন না আধুনিক প্রজন্মের অনেকেই।
এর উত্তর খুঁজতে গেলে ফিরে তাকাতে হয় লোকবিশ্বাস, পুরাণ আর ঐতিহ্যের দিকে। আকাশপ্রদীপ জ্বালানোর প্রধান এবং সর্বাধিক প্রচলিত কারণটি হল পিতৃপুরুষদের পথ দেখানো। বিশ্বাস করা হয়, মহালয়ার পূণ্যতিথিতে পূর্বপুরুষরা জল-তর্পণে তুষ্ট হয়ে মর্ত্যে নেমে আসেন এবং দীপাবলি পর্যন্ত নিজ নিজ পরিবার-পরিজনের কাছাকাছি অবস্থান করেন। দীপাবলির অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারে তাঁদের স্বর্গলোকে ফেরার পথ যাতে গুলিয়ে না যায়, তাই সেই পথ আলোকিত করার জন্যই বংশধরেরা উঁচু জায়গায় আকাশপ্রদীপ জ্বালিয়ে দেন। এই স্নিগ্ধ আলো তাঁদের যাত্রাপথকে সুগম করে তোলে, এমনটাই বিশ্বাস। এটি একদিকে যেমন পিতৃপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানানোর একটি মাধ্যম, তেমনই তাঁদের আত্মার শান্তিকামনার প্রতীক।

তবে কারণ শুধু একটি নয়। আকাশপ্রদীপের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও নানা পৌরাণিক কাহিনি। চোদ্দ বছর বনবাস এবং লঙ্কাজয়ের পর দীপাবলির দিনই শ্রীরামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরেছিলেন। তাঁর প্রত্যাবর্তনের আনন্দে অযোধ্যাবাসী সমগ্র নগর দীপমালায় সাজিয়ে তুলেছিল। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তকে স্মরণ করেও অনেকে আকাশপ্রদীপ জ্বালান। উঁচু জায়গায় রাখা এই প্রদীপ যেন দূর থেকে বিজয়ীর ঘরে ফেরার পথকেই আলোকিত করে।
পাশাপাশি, দীপাবলি হল ধন ও সমৃদ্ধির উৎসব। পাশাপাশি অনেকে এই দিন শ্যামা মায়ের পূজা করেন। বিশ্বাস করা হয়, এই অমাবস্যার রাতে দেবী তাঁর ভক্তদের গৃহে পদার্পণ করেন। নিজের বাড়িকে দেবীর কাছে আরও আকর্ষণীয় এবং উজ্জ্বল করে তুলতে, এবং অন্ধকার দূর করে তাঁর আগমনকে স্বাগত জানাতে আকাশপ্রদীপ জ্বালানোর প্রথা প্রচলিত রয়েছে অনেক জায়গায়। এটি যেন দেবীকে নিজের গৃহে আসার জন্য এক আলোর আমন্ত্রণ।
এই সমস্ত কারণের ঊর্ধ্বে রয়েছে এক গভীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য। দীপাবলির অমাবস্যা বছরের সবচেয়ে অন্ধকার রাতগুলোর মধ্যে অন্যতম। আকাশপ্রদীপ এই বাহ্যিক অন্ধকারের পাশাপাশি আমাদের অন্তরের অজ্ঞানতা, বিদ্বেষ এবং সকল প্রকার নেতিবাচকতা ভাবনার অন্ধকারকে দূর করার প্রতীক। এটি মঙ্গলের জয় এবং অশুভ শক্তির বিনাশের বার্তা দেয়।
আজকের দিনে হয়তো আকাশপ্রদীপের জৌলুস কিছুটা কমেছে, কিন্তু তার গুরুত্ব কমেনি। তাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, আধুনিকতার হাজারো রোশনাইয়ের মধ্যেও এক চিলতে স্নিগ্ধ আলো নিয়ে দীপাবলির আকাশকে অর্থবহ করে তোলে এই আকাশপ্রদীপ। এটি শুধু একটি প্রথা নয়, এটি ঐতিহ্য, বিশ্বাস এবং শুভকামনার এক অনির্বাণ শিখা।
