নিজস্ব সংবাদদাতা: সমাজের মূলস্রোতের চেনা হিসাবের বাইরে যাদের জগৎ । সম্ভবত সমাজের একেবারে প্রান্তিক স্তরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাঁরা। মানসিক রোগ থেকে সেরে উঠে স্বাভাবিক জীবনে মিলতে পারার আগে বেশ খানিকটা সময় লাগে। ‘প্রত্যয়’-এর বাসিন্দারা এখন সেই চেষ্টায় মগ্ন। মনোরোগ থেকে সেরে ওঠা মানুষদের ঘর এই ‘প্রত্যয়’। রাজ্য সরকার ও ‘অঞ্জলি’-র প্রচেষ্টায় তাঁদের বাড়ি হয়ে উঠেছে  ‘প্রত্যয়’।

 

‘প্রত্যয়’-এর কাজ হয় মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায়ের উপদেশ মতো। তাঁকে যোগ্য সঙ্গত দেন পিয়া চক্রবর্তী। সম্প্রতি, প্রত্যয় আয়োজন করেছিল এক ‘কেক মিক্সিং’ উৎসব।  আসলে, বড়দিনের মরশুম ও কেক প্রায় সমার্থক। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গোটা দেশ ও রাজ্যের বিভিন্ন আনাচেকানাচে যখন আয়োজন করা হচ্ছে এই উৎসব এবং তাতে সাধারণ মানুষ থেকে তারকারা যোগ দিচ্ছেন, তাহলে কেন-ই বা পিছিয়ে থাকবে প্রত্যয় -এর আবাসিকরা? মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায়ের কথায়, "আমাদের বরাবরের উদ্দেশ্যই থাকে যাঁরা এখানকার আবাসিক তাঁদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগটা যেন বাড়ে, মোলাকাতটা যেন 'ছোটি' না থেকে বৃহত্তর হয়। আর যত তা হবে, তত এই ধরনের মানুষের বিষয়ে ভিত্তিহীন ধারণা, কুসংস্কার খানিকটা হলেও কাটবে। এবং এই আবাসিকদের তো সমাজের মূলস্রোতে ফিরতে হবে, কাজ করে খেতে হবে। কারণ 'প্রত্যয়' তো আর কোনও সৈকতাবাস নয়। আর তাই এঁদের কাজের সুযোগ দেওয়ার জন্য সাধারণ মানুষেরও তো উচিত তাঁদের দেখা, বোঝা। সেই জায়গা থেকেই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন আমাদের।"

 

রাজ্যের নারী সুরক্ষা এবং শিশু কল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজার এই অনুষ্ঠানে আসার কথা থাকলেও তিনি আস্তে পারেননি প্রশাসনিক জরুরি বৈঠকের কারণে তিনি আসতে পারেননি। তবে নিজের দপ্তরের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদাধারীকে তিনি পাঠিয়েছিলেন প্রত্যয়-এ। তাঁরা ঘুরে ঘুরে সমস্ত বিষয়টি যেমন দেখলেন, তেমন টুকটাক কথাও বললেন আবাসিকদের সঙ্গে। এরপরেই তাঁদের উপস্থিতিতে বসেছিল জমজমাটি কেক মিক্সিং  উৎসবের আসর। মাখনের মধ্যে নানা ধরনের বাদাম, কিশমিশ, ফলের মাখামাখি! সবার সঙ্গে মহা আনন্দে 'প্রত্যয়'-এর আবাসিকরাও গ্লাভস হাতে নেমে পড়েছিলেন কেক মিক্সিংয়ের কাজে!

 

সমাজকর্মী হিসাবে বেশ পরিচিতি রয়েছে পিয়ার। নারীবাদী হিসাবেও পরিচিত তিনি। পিয়া চক্রবর্তীর কথায়, " এই সময়টায় প্রত্যয়-এর জন্য এরকম অনুষ্ঠান জরুরি কারণ এটা উৎসবের মরশুম। তবে আমাদের কিন্তু সারা বছরেই কাজ চলে। বিশ্বকর্মা পুজো থেকে বসন্ত উৎসব। দুর্গাপুজোতেও প্রত্যয় -এর আপনজনেরা বাসে চেপে মজা করে ঠাকুর দেখতে বেরোন।  আসলে, প্রত্যয় -এর  জন্য উৎসবটা কিন্তু শুধুই উৎসব নয়। বরং সমাজের দেওয়ালের দুই প্রান্তে থাকা মানুষদের এক বিন্দুতে আসার একটি মাধ্যম। একটি সেতু বলতে পারেন। আর সমাজের এই ধরনের প্রান্তিক মানুষের কাছে কিন্তু ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এই ব্রিজে পৌঁছনো। তাঁদের সুস্থতার জন্যেও। কারণ সাধারণত তাঁদের আলাদা করে দেয় সমাজ, দূরে দূরে রাখে।  তাই এই ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁদেরও মনে হয় বৃহত্তর সমাজের অংশ তাঁরাও।" 

 

সামান্য থেমে তিনি আরও বলেন, "আর এঁদের মধ্যে উৎসাহ দেখার মতো। সারা বছর তাঁরা অপেক্ষা করে থাকেন কখন এই ধরনের উৎসবে তাঁরা যোগদান করবেন। একটু বাইরে যাবেন, উদ্‌যাপন করবেন।  সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁদের দেখাসাক্ষাৎ হবে। আর জানেন, তাঁরাও সাধারণ মানুষের সম্পর্কে একটা বেশ কৌতূহল রয়েছে আবার চাপা অভিমানও রয়েছে।" পিয়া চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে উঠল তাঁর স্বামী তথা অভিনেতা-পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ। মিষ্টি হেসে তিনি বললেন, "পরমের সঙ্গে প্রত্যয় নিয়ে বহু কথা হয়েছে, হয়। ও অত্যন্ত একজন সংবেদনশীল মানুষ। প্রত্যয়-এর আবাসিকদের নিয়ে ও অনেককিছু জানতে চায়। পরমের বহুবার এখানে আসার পরিকল্পনা হয়েও কাজের শিডিউলের জন্য ভেস্তে গিয়েছে। তবে সুযোগ ও সময় পেলেই ও আসবে।"  


প্রসঙ্গত, প্রত্যয় -এর আপনজনেরা কিন্তু জোরকদমে শিল্পচর্চাও করছেন। রত্নাবলী রায়ের পরামর্শে তাঁদের হাতে তৈরি জিনিস নিয়ে হয়েছে প্রদর্শনী। এখনও চলছে। আবাসনের হলঘরে। সেরামিকের কাজ, ব্লক প্রিন্টের কাজ দেখা যাবে সেখানে।

 


চারপাশে তখন ম'ম করছে ওয়ালনাট মাফিন,ওয়ালনাট ব্রাউনির গন্ধ। লম্বা কাঠের টেবিলের উপর টুকরির মধ্যে থরে থরে সাজানো স্ট্রবেরি ক্রাশ, মার্বেল কেক, কেপি গুজবেরি। চোখ টানল একপাশে  সুদৃশ্য চিনেমাটির প্লেটে সাজিয়ে রাখা ক্যাপুচিনো ব্রাউনির দলকেও। সাজানোর মধ্যেই স্পষ্ট যত্ন ও মমতার ছোঁয়া। এবং গুনগুন করে সাউন্ড বক্স থেকে বাজছে ক্রিসমাস ক্যারল। শুধু ছোট্ট ছোট্ট তুলোর বলের মতো তুষারপাত হওয়াটাই যা বাকি। জানা গেল, 'প্রত্যয়' -এর আবাসিকেরাই এইসব কেক বানিয়েছেন! জানালেন রত্নাবলী রায়-ই। অবশ্য চমকের শেষ পর্দা তখনও পড়া বাকি! 

 

মশগুল হয়ে এদিক-ওদিক দেখছি এমন সময় প্রত্যয় -এর দো'তলা থেকে ভেসে এল আধো অথচ নির্ভুল ইংরেজি উচ্চারণের ক্রিসমাস ক্যারল। মুহূর্তে সবাই চুপ। মুখে হাসি, চোখে আগ্রহ নিয়ে গায়িকাকে একমনে খুঁজে চলেছেন সবাই। অবশেষে দেখা পাওয়া গেল তাঁর। দো'তলার লম্বা বারান্দায় হাত ঘুরিয়ে, একগাল হাসিমুখে মিষ্টি স্বরে ক্যারল গেয়ে চলেছেন তিনি। এতগুলো দর্শকের উপস্থিতি, দৃষ্টি বিলকুল উপেক্ষা করেই! 

কে যে বলে কলকাতায় মাত্র একদিন ক্রিসমাস থাকে?