বেশ কয়েক বছর ধরেই রকেটগতিতে বাড়ছে উচ্চশিক্ষার খরচ। ফলে সাধারণ মধ্যবিত্তের রোজগারে পছন্দমতো কেরিয়ারের দিকে সন্তানকে এগিয়ে দেওয়া ক্রমেই চলে যাচ্ছে নাগালের বাইরে। এখানেই ভরসা হয়ে ওঠে এডুকেশন লোন। বিভিন্ন ব্যাঙ্ক বা ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন এখন নানা ধরনের শিক্ষাঋণ নেওয়ার সুযোগ দেয়। ফলে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা হোক বা পিএইচডি, কিংবা নানা ধরনের প্রফেশনাল কোর্স, এডুকেশন লোনের পথে হেঁটে স্বপ্নপূরণের দরজা খুলছে অজস্র পড়ুয়ার। আপনিও কি নিজের বা সন্তানের উচ্চশিক্ষায় ঋণ নেওয়ার কথা ভাবছেন? তা হলে বরং জেনে নিন প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য।
কাকে বলে এডুকেশন লোন
উচ্চশিক্ষার খরচ মেটাতে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ দেয়। পড়ুয়া নিজে কিংবা তার অভিভাবক এই লোন নিতে পারেন। ঋণের টাকা হাতে পাওয়ার পরে ৬ মাস বা ১ বছর (কিছু সরকারি ব্যাঙ্কের নিয়মে আর একটু বেশি সময়সীমা) থাকে মোরাটোরিয়াম পিরিয়ড। ওই সময়সীমা পেরনোর পরে নির্ধারিত অঙ্কের ইএমআই-তে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হয়। বাবা-মা, ভাইবোন বা যিনি ঋণ নিয়েছেন, পরিশোধের দায়িত্ব তাঁর। কোর্স শেষ হলে বা চাকরি পেয়ে গেলে এই ঋণ পরিশোধ করতে পারেন পড়ুয়া নিজেও। শিক্ষাঋণের শর্ত, নিয়মকানুন বা সুদের হার বিভিন্ন ব্যাঙ্ক বা প্রতিষ্ঠান ভেদে আলাদা হতে পারে।
যে সব ক্ষেত্রে শিক্ষাঋণ মেলে
এ দেশে স্নাতক স্তর থেকেই এডুকেশন লোনের সুবিধা পাওয়া যায়। যে সব কোর্সের জন্য এই ঋণ পেতে পারেন: 
 
 •    বিভিন্ন ধরনের স্নাতক ও ডিপ্লোমা কোর্স 
 
 •    বিভিন্ন ধরনের স্নাতকোত্তর ও ডিপ্লোমা কোর্স
 
 •    ডক্টরাল কোর্স
 
 •    কম্পিউটার, এমবিএ, নার্সিং, টিচিং-সহ বিভিন্ন পেশা-নির্ভর সার্টিফিকেট কোর্স
 
 •    ইঞ্জিনিয়ারিং, এগ্রিকালচার, ভেটেরিনারি কোর্স-সহ বিভিন্ন পেশামুখী ডিপ্লোমা
 
 •    আর্মি, নেভি, এয়ারফোর্স, এরোনটিকস, পাইলট ট্রেনিংয়ে ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা
 
 •    স্টেট স্কিল মিশন বা ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের বিভিন্ন কোর্স
 
 •    বিভিন্ন সফ্ট স্কিল, অ্যানিমেশন, ডিজিটাল মার্কেটিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), ডেটা সায়েন্স, ইংরেজি শিক্ষা, স্পোকেন ইংলিশ, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট-সহ বিভিন্ন আধুনিক বিষয়ে শর্ট টার্ম কোর্স
 
 কখন মিলবে শিক্ষাঋণ
এ দেশে এডুকেশন লোন পেতে হলে সংশ্লিষ্ট পড়ুয়াকে দেশ বা বিদেশের স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানে অ্যাডমিশন নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন (ইউজিসি), অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন (এআইসিটিই), ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমএস) প্রভৃতির স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে অ্যাডমিশন হয়ে গিয়ে থাকলে লোন পাবেন। আইসিডব্লিউএ, সিএফএ, সিএ-র মতো কোর্সের ক্ষেত্রে সেগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হতে হবে। এরোনটিকস, শিপিং বা পাইলট ট্রেনিং, নার্সিং বা এই সংক্রান্ত কোর্সের জন্য লোন পেতে হলে কোর্সগুলি ডিরেক্টর জেনারেল অফ সিভিল এভিয়েশন/ শিপিং/ইন্ডিয়ান নার্সিং কাউন্সিল অনুমোদিত হতে হবে।
এডুকেশন লোন নিতে হলে
বিভিন্ন ব্যাঙ্ক বা প্রতিষ্ঠানের এডুকেশন লোনের জন্য নির্দিষ্ট নীতি বা নিয়মাবলি রয়েছে। তবে শিক্ষাঋণ নিতে হলে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি মাথায় রাখা জরুরি:
 
 •    ১৬ থেকে ৩৫ বছরের পড়ুয়ার জন্য এডুকেশন লোনের সুবিধা পাওয়া যায়। 
 
 •    সাধারণত দেশের কোনও প্রতিষ্ঠানের কোর্সের জন্য ১ কোটি টাকা পর্যন্ত এবং বিদেশের প্রতিষ্ঠানের জন্য ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত লোন মেলে।
 
 •    ঋণ পেতে হলে সংশ্লিষ্ট কোর্সে অ্যাডমিশন নিশ্চিত হওয়ার নথি দাখিল করা জরুরি। 
 
 •    এই ঋণ নিতে পারেন পড়ুয়া নিজে, তাঁর বাবা/মা, ভাই/বোন, শ্বশুর/শাশুড়ি
 
 •    পরিশোধের ঝুঁকি বেশি থাকার কারণে এডুকেশন লোনের সুদও বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই হার অন্তত ৮ থেকে ১৬ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করে।
 
 •    এই লোনের সুদের হার সাধারণত সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক বা ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন এবং নির্ধারিত কোর্সের উপর নির্ভর করে।   
 
 •    ঋণ পরিশোধের সময়সীমা সাধারণ ভাবে ১৫ বছর। কিছু ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বাড়তি মেয়াদ বা শর্তসাপেক্ষে বেশি সময়ের জন্য পরিশোধের সুযোগ দেয়।    
 
 •    যিনি ঋণ নেবেন, পরিশোধের দায়িত্ব তাঁর। কিছু ক্ষেত্রে বাড়তি সুরক্ষার জন্য ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাড়তি একজনকে গ্যারান্টার বা কো-বরোয়ার হিসেবে নথিভুক্ত করে।
 
 •    কিছু ক্ষেত্রে এই লোনের জন্য কোল্যাটেরাল হিসেবে বাড়ি বা সম্পত্তি বন্ধক রাখতে হয়। প্রয়োজন হতে পারে মোটা টাকার ব্যাঙ্ক ব্যালান্সও।  
যা যা নথি প্রয়োজন
এডুকেশন লোন পেতে নির্দিষ্ট কিছু নথি দাখিল করতে হয়। তালিকায় রয়েছে:
 
 পড়ুয়ার ক্ষেত্রে:
 
 •    পরিচয়, বয়স, ঠিকানার প্রমাণপত্র 
 
 •    বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পাসপোর্ট
 
 •    দশম এবং দ্বাদশের মার্কশিট, উচ্চচর শিক্ষার ক্ষেত্রে স্নাতক স্তরের মার্কশিট
 
 •    জয়েন্ট, ক্যাট, সিম্যাট নিট, সিইটি, জিম্যাট, জিআরই, টোয়েফল ইত্যাদি এনট্রান্স পরীক্ষার মার্কশিট
 
 •    অ্যাডমিশনের নথি বা অফার লেটার
 
 •    সংশ্লিষ্ট কোর্সের খরচের হিসেব
 
 •    সংশ্লিষ্ট কোর্স বা প্রতিষ্ঠানের প্রসপেক্টাস
 
 •    পাসপোর্ট সাইজ ছবি
 
 •    ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট
কো-অ্যাপ্লিক্যান্ট বা গ্যারান্টারের ক্ষেত্রে:
•    পরিচয়, ঠিকানার প্রমাণপত্র
 
 •    পাসপোর্ট সাইজ ছবি 
 
 •    চাকরি বা ব্যবসা থেকে আয়ের প্রমাণপত্র
 
 •    আয়কর রিটার্ন 
এডুকেশন লোন নেওয়ার সুবিধে
শিক্ষা ঋণ বেশ কিছু সুযোগ সুবিধের দরজা খুলে দেয়। যেমন, 
 
 •    লোনের অ্যাপ্রুভাল দ্রুত পাওয়া যায়।
 
 •    এখনকার স্মার্ট এবং ডিজিটাল মাধ্যমে লোনের প্রক্রিয়া সহজ এবং চটজলদি। 
 
 •    ঋণ বা ইএমআই-এর অঙ্ক, পরিশোধের সময়সীমা নিজের চাহিদা বা সামর্থ্য অনুযায়ী সাজিয়ে নেওয়া যায়। 
 
 •    শিক্ষাঋণ নিলে আয়কর ছাড়ের সুবিধা রয়েছে। 
 
 •    সুবিধামতো থোক টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধের সুযোগ থাকে।
 
 •    মার্জিন-ফ্রি ওয়েভারের সুযোগ দেয় কিছু ব্যাঙ্ক বা প্রতিষ্ঠান। 
 
 •    কিছু ব্যাঙ্ক বা প্রতিষ্ঠানের তরফে কোল্যাটেরাল-বিহীন লোন নেওয়ার সুবিধা মেলে। 
 
 •    কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কী কী চার্জ বা ফি নিচ্ছে, সে বিষয়টিও স্বচ্ছভাবে বলা থাকে।
এডুকেশন লোনে কিছু অসুবিধার জায়গা
শিক্ষাঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় কারও কারও ক্ষেত্রে অসুবিধাজনকও হতে পারে। সেগুলিও জানা থাক আগেভাগে। 
 
 •    বড় অঙ্কের এডুকেশন লোন পেতে হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোল্যাটেরাল বা গ্যারান্টির প্রয়োজন। বাড়ি বা সম্পত্তি বন্ধক রাখা কিংবা গ্রহীতা বা গ্যারান্টারের মোটা টাকার ব্যাঙ্ক ব্যালান্স বা স্থায়ী আয় না থাকলে বেশি টাকার ঋণ পাওয়া কঠিন। বিশেষত বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এ বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে। 
 
 •    নির্দিষ্ট ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অ্যাপ্রুভড তালিকায় থাকলে তবেই শিক্ষাঋণ মেলে। তবে আশার কথা, ইদানীং বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠিত বা স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ওই তালিকায় জায়গা করে নেয়। 
 
 •    শিক্ষাঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বাড়তি ঝুঁকি থাকে ব্যাঙ্ক বা ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনের। তাই অন্যান্য ঋণের তুলনায় এক্ষেত্রে বার্ষিক সুদের হারও বেশি। 
মনের মতো প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা লাভের স্বপ্ন দেখেন বহু পড়ুয়াই। অনেক ক্ষেত্রে তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় আর্থিক সামর্থ্য। টাকার অভাবে কাঙ্ক্ষিত কেরিয়ারের পথ যাতে বন্ধ হয়ে না যায়, তা নিশ্চিত করতেই তাই এখন এডুকেশন লোন বেছে নিচ্ছে বহু পরিবার।
