পরমা দাশগুপ্ত
পুজো-দীপাবলির মরসুম শেষ হতে না হতেই মনের কোণে বড়দিন-নতুন বছরের উঁকিঝুঁকি। সকাল-সন্ধের বাতাসেও তো একটু যেন শীত শীত। ব্যস, ওমনি ছুটি ছুটি মেজাজ, মন উড়ু উড়ু! শীতের বেড়ানোর প্ল্যানটা এবারে করে ফেললেই হয়! তবে তার আগেই যদি বেরিয়ে পড়ার সাধ জাগে?
কাজের চাপ সামলে লম্বা ছুটির সুযোগ অনেকেরই অবশ্য হয়না এ সময়টায়। তাতে কি? শনি-রবি কিংবা লং উইকেন্ড আছে তো! আর হাতের কাছেই আছে বেশ কয়েকটা জঙ্গল, এই বাংলাতেই। ওই যাকে বলে, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া। বুনো গন্ধ আর শীতের ওমে মাখামাখি হয়ে আলসে মেজাজে কাটিয়ে ফেলা দিন দুয়েক। তার যে স্বাদই আলাদা!
সুন্দরবন বা ডুয়ার্সের ভিড়ভাট্টায় যেতে মন চাইছে না? ঘরের কাছে জঙ্গল তো আরও আছে। জঙ্গলমহলের গোটা অঞ্চলটা ভাগ করে নিলে বেশ কয়েকটা জংলা ছুটির ঠিকানা তো মিলেই যায়। উইকেন্ড ডেস্টিনেশন হিসেবে তাদের মেজাজ কিংবা আমেজ, দুটোই দারুণ। আসুন জেনে নেওয়া যাক, কোথায় কোথায় যেতে পারেন।
ঝাড়গ্রামঃ কলকাতা থেকে ছবির মতো গাছে ঘেরা ঝকঝকে পিচের রাস্তা ধরে লং ড্রাইভ। যেতে পারেন ট্রেনেও। ঘণ্টা চার-পাঁচেকেই পৌঁছে যাবেন সবুজ বনের দেশে, যার আনাচকানাচে হাতির করিডর ঠাসা। ঝাড়গ্রাম জুড়ে অজস্র হোটেল, হোমস্টে রয়েছে এখন। তার কয়েকটা একেবারে জঙ্গল ঘেঁষে। ঘুম ভাঙবে চেনা-অচেনা অজস্র পাখির ডাকে। তারপর ইতিউতি ঘুরুন জঙ্গলের বুক চিরে যাওয়া লালমাটির পথ বা ছায়া ছায়া গাছের ফাঁক দিয়ে আঁকাবাঁকা শুঁড়ি পথ ধরে। পাখির দল, বাঁদরের পাল, হরিণ, শেয়ালেরা তো আছেই। কপাল ভাল থাকলে দেখা হয়ে যেতে পারে হাতিদের সঙ্গেও। সঙ্গে আছে কনকদুর্গার মন্দির, ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি, আদিবাসী গ্রাম, নদী আর জলপ্রপাতে ঘোরাঘুরি।
ভাল্কিমাচান, বর্ধমানঃ ডে-আউট কিংবা শনি-রবিতে টুক করে ঘুরে আসার ঠিকানা খুঁজছেন? কলকাতা থেকে গাড়িতে মাত্র ঘণ্টা তিনেকের পথ বর্ধমান জেলার এই জঙ্গল। হাওড়া আসানসোল রুটে মানকড় স্টেশনে নেমেও পৌঁছে যেতে পারেন। এক সময়ে এ জঙ্গলে ভালুক ছিল। গ্রামবাসীদের নিরাপদে রাখতে তৈরি হয়েছিল নজরদারি আর ভালুক শিকারের মাচা। তার থেকেই এ জঙ্গলের এমন নাম। ভাঙাচোরা সেই ওয়াচ টাওয়ার আজও দাঁড়িয়ে সবুজের মাঝে। আছে পোড়ো মন্দির, গড়ের ভগ্নাবশেষ। ভালুক পাবেন না ঠিকই, তবে পাখি আর ছোটখাটো প্রাণীর দেখা মিলবে। অঢেল সবুজ আর অপার নীরবতায় এ জঙ্গল মন কাড়তেই পারে। থাকার জায়গা অবশ্য কম। একেবারে জঙ্গল লাগোয়া কিংবা একটু দূরে সরকারি হোটেলে থাকতে পারেন। শীতের ছুটিতে টেন্টে থাকতেও মন্দ লাগবে না। ক্যাম্পফায়ার, কাছের গ্রামে সাঁওতালি নাচ, বোটিং মিলিয়ে এ এক অন্য রকম ছোট্ট ছুটি।
জয়পুর জঙ্গল, বাঁকুড়াঃ কলকাতার কাছেই এ আরও এক বুনো ঠিকানা। গাড়িতে মাত্র ১৪০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পৌঁছে যাবেন বাঁকুড়া জেলার এই অচেনা জঙ্গলে। ট্রেনে বিষ্ণুপুর হয়েও যেতে পারেন। জঙ্গলের কাছাকাছি এবং আশপাশ মিলিয়ে কিছু হোটেল আছে এখন। হাইওয়ে থেকে নজর কাড়বে শাল-পলাশ-মহুয়ায় ঘেরা বন। উঁচু গাছের মাথারা চাঁদোয়ার মতো আকাশ ঢেকে রাখে এখানে। ঘন জঙ্গলে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে অজস্র পাখি, চিতল হরিণ। আছে হাতির দল। লালমাটির পথ বেয়ে ঘুরে বেড়ান এদিক-সেদিক। দিনের বেলাও ঝিঁঝি-ডাকা নির্জনতায় বুক ভরে শ্বাস নিন বুনো ফুলের গন্ধ মাখা বাতাসে। মেখে নিন গাছের পাঁচিল পেরিয়ে ঢুকে পড়া রোদের ওম। গড়িয়ে গড়িয়ে দিন এগোক সূর্যাস্তের দিকে। তার পরে হোটেলে ঢুকে পড়লেই হল।
রাকাব বন, পুরুলিয়াঃ এক সময়ে এ জঙ্গল ছিল শিকারভূমি। নাম ছিল ষোলো ক্রুশের জঙ্গল। পুরুলিয়ার কেশরগড়ের এই রাকাব বনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ব্রিটিশদের সঙ্গে রাজার যুদ্ধ আর কোষাগার লুঠের ইতিহাস। রাজার সেই ভাঙাচোরা দুর্গ আজ জরাজীর্ণ, দাঁড়িয়ে আছে ঘন জঙ্গলের আড়ালে। শাল-পলাশের সারি, পাখপাখালির ডাক, হাতি-সহ নানা জীবজন্তু, আর অতীতের গন্ধ মাখা এই সবুজ বন পুরুলিয়া শহর থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরে। ফলে চাইলে থাকতে পারেন শহরেই। কলকাতা থেকে যেতে পারেন গাড়িতে কিংবা ট্রেনে।
হাল্কা শীতের ছোঁয়ায় অরণ্যের দিনরাত্রি আর সপ্তাহান্তে বুক ভরে নেওয়া অক্সিজেন। ছুটন্ত জীবনের ফাঁক গলে একটুকরো আনন্দ খুঁজবেন নাকি?
