জমিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে শীতের মরশুম। বাঙালির শীতপ্রেমের কথা সর্বজনবিদিত। প্রতি বছরই হাড়কাঁপানো ঠান্ডার পাশাপাশি নাতিশীতোষ্ণর মোলায়েম আবহাওয়াও দিব্যি টের পায় এ রাজ্যের মানুষ। আবার শীত মানেই ছোটবেলার স্মৃতির পাশাপাশি এদিক সেদিক টইটই। এমনই আবহে প্রয়াত কিংবদন্তি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক অসামান্য 'ঠান্ডা অভিজ্ঞতা' শোনালেন তাঁর স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়। যা একইসঙ্গে বোহেমিয়ান, সহজ এবং মনকেমনকরা।

“সুনীল ঘুরতে খুব পছন্দ করত। ছেলেবেলা থেকেই। তখন থেকেই এই হঠাৎ-হঠাৎ বেরিয়ে পড়ার ব্যাপারে ওর হাতেখড়ি। ছুটি পেলেই বেরিয়ে পড়ত। স্কুলে পড়াকালীন তো ‘বয়েজ স্কাউটস’-এরও সদস্য ছিল। সম্ভবত, তখন থেকেই এই ঘুরে বেড়ানোর নেশা ওকে পেয়ে বসেছিল। কখনও কখনও এইসব অভিজ্ঞতা যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনই আঁতকে ওঠার মতো। এখন তো কলকাতায় বেশ শীত পড়ে গিয়েছে, সুনীলের একটি মজার ঘটনা বলি। সেটাও শীতের সময় ছিল আর এই ঘুরে বেড়াতে গিয়েই হয়েছিল।
সুনীল তখন সম্ভবত স্কুল কিংবা সদ্য কলেজ। ততদিনে এই হুট করে বেরিয়ে যাওয়া-টাওয়ায় ও পাকা হয়ে উঠেছে। ওর এক বন্ধু ছিল, যার বাবা রেলের বড় অফিসার গোছের কেউ ছিলেন। সুতরাং সুনীলের সেই বন্ধু ও তাঁর ভাই রেলের পাস পেত। আর সুনীল করত কী, ওর বন্ধুর ভাই সেজে দু'জনে মাইল ওই পাস নিয়ে রেখে উঠে পড়ত। অনেক জায়গায় ওরা দু'জন মাইল গিয়েছে। এমনও হয়েছে, যেতে যেতে কোনও স্টেশন বা তার আশেপাশে জায়গা দেখে ভারী পছন্দ হয়েছে, অমনি টুক করে নেমে পড়েছে তারা, ওখানেই!
এই ঘটনা যখনকার, সেই বছর বেশ জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে। সুনীল আর তার সেই বন্ধু রেলে উঠে ঘুরতে ঘুরতে হায়দরাবাদ চলে গিয়েছে। তো নেমে স্টেশনের ক্লোকরুমে ওদের সঙ্গে থাকা সামান্য মালপত্রের ব্যাগ রেখে হায়দরাবাদ শহর ঘুরতে বেরিয়ে গিয়েছে। সারাদিন টো-টো করে ঘুরেফিরে স্টেশন ফিরল। কারণ হোটেলে থাকার তো পয়সাই ছিল না ওদের কাছে। যাই হোক, ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। এদিকে ক্লোকরুম ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে! বাইরে তখন জম্পেশ ঠান্ডা। সুনীল আর তার সেই বন্ধুর কাঁপুনি শুরু হয়ে গিয়েছে। গরম জামাকাপড় ছিল তো সব ওই ব্যাগে। অনেক রাত পর্যন্ত ওরা দু'জন মিলে প্ল্যাটফর্ম চত্বরে বসে ঠান্ডায় কাঁপতে লাগল। আর কী-ই বা করবে তখন। এমন সময় সুনীলের চোখে পড়ল, প্ল্যাটফর্মে কয়েকজন ভিখিরি চাদর-কম্বল জড়িয়ে শুয়ে রয়েছে। একসময় ঠান্ডায় আর থাকতে না পেরে ওদের পাশেই শুয়ে পড়েছিল দুই বন্ধু। তাতেও কি আর শীত কমে? শেষমেশ ওই ভিকিরিদের থেকে তাঁদের চাদর-কম্বলের ভাগ চেয়েছিল সুনীল! তারাও আপত্তি করেনি। দেরি না করে ওদের সঙ্গেই কম্বলের তলায় ঢুকে পড়েছিল সুনীল! সে-রাতে ওভাবেই ঠান্ডার হাত থেকে বেঁচেছিল সুনীল। পরে আড্ডায় অবশ্য খুব মজা করেই বলত এই ঘটনাটা।”
