আজকাল ওয়েবডেস্ক: অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারী কেন পুরুষের তুলনায় বেশি দিন বাঁচেন—এই প্রশ্ন বহু দশক ধরে বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে। বিষয়টি শুধু মানুষেই সীমাবদ্ধ নয়। জঙ্গলের গোরিলা থেকে শুরু করে আকাশের চড়ুই—প্রায় সব প্রজাতিতেই একই ধারা লক্ষ্য করা যায়।


এর উত্তর পাওয়া যায় না শুধু হাসপাতালের শয্যায় বা খাদ্যাভ্যাসে। রহস্য লুকিয়ে আছে জিনে, প্রাণীর প্রজনন প্রতিযোগিতায় এবং বিবর্তনের গভীর যুক্তিতে। স্তন্যপায়ীদের মধ্যে দেখা যায়, স্ত্রী প্রাণীরা নিয়মিতভাবে পুরুষদের তুলনায় দীর্ঘায়ু হন। গড়ে প্রায় ১৩ শতাংশ বেশি। কিন্তু পাখিদের ক্ষেত্রে চিত্রটি উল্টো—অসংখ্য প্রজাতিতে পুরুষ পাখি স্ত্রীদের তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ বেশি দিন বাঁচে।


এতে প্রমাণিত হয় যে দীর্ঘায়ু শুধু শরীরের আকার বা শক্তির ওপর নির্ভর করে না। বরং নির্ভর করে প্রজাতি কিভাবে বিবর্তিত হয়েছে টিকে থাকার, প্রজননের এবং সন্তানদের সুরক্ষার জন্য।


জিন এখানে বড় ভূমিকা রাখে। স্ত্রী স্তন্যপায়ী প্রাণীদের থাকে দুটি এক্স ক্রোমোজোম। ফলে কোনও একটি ক্রোমোজোমে ক্ষতিকর মিউটেশন হলেও অপরটি তাকে আংশিকভাবে সামলে নিতে পারে। কিন্তু পুরুষদের থাকে একটি এক্স এবং একটি ওয়াই ক্রোমোজোম—ফলে তাদের প্রতিরক্ষার সুযোগ কম। পাখিদের ক্ষেত্রে এর বিপরীত—ওখানে স্ত্রী পাখির থাকে ZW আর পুরুষের ZZ ক্রোমোজোম। তাই স্ত্রী পাখির অসুবিধা থেকেই পুরুষদের আয়ু তুলনামূলক বেশি।

আরও পড়ুন: জীবনের মাঝপথে নতুন সূচনা: ভারতীয় মহিলা পেশাজীবীদের দ্বিতীয় ইনিংস


তবে প্রকৃতির নিয়ম সব সময় একইভাবে চলে না। যেমন শিকারি পাখিদের মধ্যে স্ত্রী পাখিরাই বেশি দিন বাঁচেন, যদিও তাদের শরীর বড় এবং শক্তিশালী।


প্রজনন প্রতিযোগিতা এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। বহুগামিতা প্রাণীদের মধ্যে পুরুষরা প্রজনন অধিকারের জন্য লড়াইয়ে নামে। শিং, দাঁত কিংবা শক্তি দিয়ে যুদ্ধের এই প্রতিযোগিতা শরীরের প্রচুর শক্তি ক্ষয় করে এবং আঘাতের ঝুঁকি বাড়ায়। এর ফলেই পুরুষদের আয়ু কমে যায়।


অন্যদিকে, বহু পাখির প্রজাতি একগামী। ফলে তাদের পুরুষদের মধ্যে লড়াইয়ের প্রবণতা কম, যা তাদের আয়ু কিছুটা বাড়িয়ে দেয়।


আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল মাতৃত্ব ও সন্তান লালনপালন। স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে সন্তানকে রক্ষা ও মানুষ করার দায়িত্ব মূলত মায়ের ওপর। তাই বিবর্তন মা’দের দীর্ঘায়ুকে বেছে নিয়েছে—কারণ মায়ের বেঁচে থাকা মানেই সন্তানের টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়ানো। বিশেষ করে প্রাইমেটদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, মেয়েরা অনেক দিন বেঁচে থাকেন যাতে সন্তান বড় হয়ে স্বাধীন হতে পারে।


চিড়িয়াখানার মতো পরিবেশে যেখানে শিকার নেই, খাবার নিশ্চিত আর চিকিৎসকও সহজলভ্য—তবুও এই পার্থক্য একেবারে মুছে যায় না। কিছুটা কমলেও স্তন্যপায়ীদের স্ত্রী প্রাণীরা তবু পুরুষদের চেয়ে বেশি দিন বাঁচেন, আর পাখিদের পুরুষরা স্ত্রীদের চেয়ে টিকে থাকেন।


মানুষও এই ধারা অনুসরণ করে। আধুনিক চিকিৎসা নারী-পুরুষের আয়ুর ব্যবধান কিছুটা কমালেও পুরোপুরি দূর করতে পারেনি। এখানে আরও একটি বিষয় হল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা। স্তন্যপায়ী নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক বেশি। ফলে তারা সংক্রমণ মোকাবিলায় ভালোভাবে সক্ষম হয় এবং দীর্ঘায়ু লাভ করে। তবে এই শক্ত প্রতিরক্ষা নতুন ঝুঁকিও আনে—অটোইমিউন রোগের প্রবণতা। পুরুষদের প্রতিরোধ দুর্বল হলেও তারা এই ধরণের জটিলতা থেকে অনেক সময় বেঁচে যান।


সব মিলিয়ে পুরুষ-নারীর আয়ুর ব্যবধান কোনও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য নয়, কোনও পরিবেশগত দুর্ঘটনাও নয়। এটি হল কোটি কোটি বছরের বিবর্তন প্রক্রিয়ায় তৈরি হওয়া নকশা। মানুষের মতো স্তন্যপায়ী ও পাখিদের জীবনেও এই প্রাচীন ও স্থায়ী ধারা অটুট আছে। ভবিষ্যতেও হয়তো এটি পুরোপুরি বদলাবে না—বরং চিকিৎসা ও সমাজের অগ্রগতির সাথে ব্যবধান কিছুটা কমতে পারে, কিন্তু বিলীন হবে না।


কারণ আমাদের আয়ুর নকশা এখনো লিখিত আছে ক্রোমোজোম, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এবং বিবর্তনের ট্রেড-অফে। এটাই প্রকৃতির প্রাচীন সত্য।