আজকাল ওয়েবডেস্ক: ১৯৭৬ সালে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়েছিল। প্রায় অর্ধশতাব্দী পর বাংলাদেশের জাতীয় কবির সমাধির পাশেই সমাধিস্ত করা হল তীব্র ভারতবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত, কট্টোরপন্থী তরুণ নেতা শরিফ ওসমান হাদিকে। যা নিয়েই বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়েছে। প্রশ্ন হল, কেন নজরুলের পাশে চির শায়িত করা হল আততায়ীদের গুলিতে নিহত কট্টোরপন্থী এই তরুণ নেতাকে?
হাদির শেষকৃত্যে শনিবার ঢাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল, হাজার হাজার মানুষ আশেপাশের শহর ও নগর থেকে এসেছিল। রাজধানীজুড়ে চরম সতর্কতা জারি করা হয়েছিল।
শুক্রবার মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুল্লা আহমেদ নিশ্চিত করেন যে, বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কাজী নজরুল ইসলামের পাশেই ওসমান হাদিকে সমাহিত করা হবে। তিনি জানান, শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের এক জরুরি অনলাইন বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

হাদির শেষকৃত্যের প্রার্থনা।
প্রক্টরের মতে, মূলত দু'টি আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রস্তাবিত কবরস্থান পরিদর্শন করে। একটি আবেদন ছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-এর তরফে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কবরের জন্য স্থান পরিদর্শনের পর খালি জায়গাগুলোর একটি মানচিত্র তৈরি করেন। এরপর সিন্ডিকেট সভায় সমাধির জন্য চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, গত সেপ্টেম্বর থেকে ডাকসুর নেতৃত্বে রয়েছে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন 'ইসলামী ছাত্র শিবির'। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ হল বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মহাম্মদ ইউনূসের নির্বাহী কার্যালয়।
ঢাকা-ভিত্তিক সংবাদপত্র দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টে ইনকিলাব মঞ্চ বলেছে যে, হাদির পরিবার কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে বাংলাদেশের তরুণ নেতাকে সমাধিস্থ করার বিষয়ে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। সংগঠনটি বলেছে, হাদির পরিবারের ইচ্ছানুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জুলাই অভ্যুথ্থানের সময় থেকেই হাসিনা সরকারের পক্ষে জোড়াল সওয়াল করতেন হাদি। তাঁর বক্তৃতায় উঠে আসত জাতীয় কবি নজরুলের নানা কবিতার পংক্তি। তাঁর মুখে বারংবার শোনা গিয়েছে- আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি। আমি অজেয় রুদ্র, আমি দুরন্ত। আকাশ ফেটে যায় আমার হাসিতে, আকাশ দোলে আমার ছোঁয়ায়। আমি আসি বন্যার মতো, ঢেউগুলোকে বুকে টেনে। আমি গাছ উপড়ে ফেলি, ছাদ ভেঙে দিই, সব ধরনের ভয়ের খেলা খেলি। আমি ঘূর্ণি, আগুন শ্বাস ফেলি, মৃত্যুর নাচ ভাসে জলে। মানুষ কাঁপে, শহর কাঁপে, ধুলো ঝরে আমার পায়ে।
অনেকেই তাই মনে করছেন, শেখ হাসিনা-বিরোধী বিদ্রোহের পর শরিফ ওসমান হাদিকে স্বঘোষিত উত্তরাধিকারী হিসেবে নজরুলের পাশে স্থান করে দেওয়া হয়েছে।

হাদির শেষকৃত্যে যোগ দিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশ।
গত সপ্তাহে ঢাকার ব্যস্ত এলাকায় দিনের বেলা মুখোশধারী বাইক আরোহী হামলাকারীদের গুলিতে আহত হন বাংলাদেশের তরুণ নেতা শরিফ ওসমান হাদি। চিকিৎসার জন্য তাঁকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হলেও শেষরক্ষা হয়নি। হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই গোটা বাংলাদেশ জুড়ে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর এবং জনতার হিংসাত্মক তাণ্ডব শুরু হয়। দেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমের দপ্তর, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং রাজনৈতিক কার্যালয়ে হামলা চালানো হয়। পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয় ময়মনসিংহে। সেখানে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করার অভিযোগে হিন্দু যুবক দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যা করে পরে তাঁর দেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে নজরুল ইসলামের সমাধি।
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত জাতীয় নির্বাচনের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে হাদির মৃত্যু ঘিরে চরম অস্থিরতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই আবহে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনূস কড়া ভাষায় জনতার হিংসার নিন্দা করেন। তিনি দেশবাসীর কাছে শান্তি ও সংযম বজায় রাখার আহ্বান জানান।
