আজকাল ওয়েবডেস্ক: দাবানল মানেই শুধু পুড়ে যাওয়া বন আর ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া আকাশ নয়। বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, সেই ধোঁয়ার ভেতরে ঘটছে আরও অদৃশ্য ও ভয়ানক এক রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া, যা আমাদের ধারণার বাইরে এতদিন চলছিল।


যখন আগুন লাগে, বিশাল পরিমাণ ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এই ধোঁয়া হাজার মাইল দূর পর্যন্ত ভেসে যেতে পারে। এর মধ্যে থাকে ক্ষুদ্র কণিকা যা বাতাস দূষিত করে এবং শ্বাস নিতে কষ্ট দেয়।


দূষণ বিশেষজ্ঞরা অনেকদিন ধরেই জানেন, দাবানলের ধোঁয়া বায়ু মান খারাপ করে। কিন্তু একটি অদ্ভুত ফাঁক থেকে যাচ্ছিল গবেষণায়। বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করছিলেন, আগুনের সময় বাতাসে অত্যন্ত সক্রিয় রাসায়নিক পদার্থ ‘পারঅক্সাইডস’-এর মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যাচ্ছে। এমন স্থানেও, যেখানে এই যৌগগুলোর গঠনের স্বাভাবিক রাসায়নিক পথ থাকা সম্ভব নয়।


সাধারণত শহরে নাইট্রিক অক্সাইডের মতো গ্যাস এই ধরনের বিক্রিয়া থামিয়ে দেয়। অথচ দাবানলের ধোঁয়ায় এগুলো অস্বাভাবিকভাবে বেশি পাওয়া যাচ্ছিল।

আরও পড়ুন: রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট হতে পারে টেকসই পরিবহনের শক্তির উৎস, পথ দেখাল কারা


এই রহস্যের সমাধান আসে সৌদি আরবের কিং আবদুল্লাহ ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এবং চায়নিজ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস-এর যৌথ গবেষণায়। তারা আবিষ্কার করেন, ধোঁয়ার মধ্যে থাকা জৈব উপাদান  যেমন গাছপালা বা কাঠ পুড়ে তৈরি হওয়া জৈব অণু অনেক সময় রঙিন ও আলোক-সংবেদনশীল হয়।


এই অণুগুলো সূর্যালোক শোষণ করলে উত্তেজিত বা সক্রিয় হয়ে ওঠে, এবং ধোঁয়ার কণিকার ভেতরেই শুরু হয় একাধিক দ্রুত রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া। ফলাফল হিসেবে তৈরি হয় পারঅক্সি র্যাঁডিকালস নামের অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল যৌগ, যা দ্রুতই পারঅক্সাইডস-এ পরিণত হয়।


এই প্রতিক্রিয়াগুলো ঘটে ধোঁয়ার কণিকার ভেতরে, বাতাসে নয়। যেভাবে প্রচলিত দূষণ তৈরি হয়। গবেষণার সহলেখক প্রফেসর চাক চ্যান, যিনি KAUST-এর ফিজিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডিন, বলেন, “এই কণিকা-নির্ভর প্রতিক্রিয়া আশ্চর্যজনকভাবে কার্যকর প্রচলিত রাসায়নিক প্রক্রিয়ার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ দ্রুত।”


যদিও পারঅক্সাইডস নিজেরা গ্রীনহাউস গ্যাস নয়, তবু এগুলো বায়ুমণ্ডলে দূষণ ছড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। এগুলো কুয়াশা বা হেজ তৈরি করে, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা বাড়ায় এবং নতুন ক্ষুদ্র কণিকার জন্ম দেয় যা বাতাসে দীর্ঘ সময় ভেসে থাকে। অর্থাৎ আগুন নিভে যাওয়ার পরও আগুনের ধোঁয়া নতুন দূষণ তৈরি করে চলতে থাকে সূর্যালোকের প্রভাবে।


এর ফলে সমস্যা কেবল আগুনের এলাকায় সীমিত থাকে না। শত শত মাইল দূরের শহরেও বাতাসে পারঅক্সাইডসের মাত্রা বেড়ে যায়, আর দূষণ পূর্বাভাসের মডেলগুলোও ভুল প্রমাণিত হয়, কারণ এতদিন এই “লুকানো রাসায়নিক পথ” তাদের হিসেবে ধরা হয়নি।


গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলে ১৯৮০-এর দশক থেকে আগুনের পরিমাণ চার গুণ বেড়েছে। ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলিতেও গত দুই দশকে আগুনে পুড়ে যাওয়া এলাকা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।


অধিক আগুন মানেই বেশি ধোঁয়া, আর বেশি ধোঁয়া মানে আরও নতুন রাসায়নিক বিক্রিয়া। এই আবিষ্কার বায়ু দূষণ পূর্বাভাসকে আরও জটিল করে তুলছে, বিশেষত যাদের হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের মতো রোগ আছে তাদের জন্য এটি বড় বিপদ। গবেষকরা এখন বলছেন, বায়ুমণ্ডলীয় মডেলগুলোকে আপডেট করতে হবে, যাতে এই “অভ্যন্তরীণ ধোঁয়া-রসায়ন”কে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। কারণ দাবানল শুধু গাছ পুড়িয়ে দেয় না এটি অদৃশ্য রাসায়নিক আগুনও জ্বালিয়ে দেয় আকাশে, যা নিঃশব্দে বদলে দিচ্ছে আমাদের নিঃশ্বাসের বাতাস।