আজকাল ওয়েবডেস্ক: স্পেন সরকার গৃহযুদ্ধকালীন ফ্যাসিবাদ-বিরোধী লড়াইয়ে অংশ নেওয়া আন্তর্জাতিক ব্রিগেডের যোদ্ধাদের উত্তরসূরি ১৭০ জনকে স্পেনের নাগরিকত্ব প্রদান করেছে। এটি মূলত তাদের antifascist সংগ্রামের প্রতি কৃতজ্ঞতার নিদর্শন এবং ফ্রাঙ্কো স্বৈরশাসনের উত্তরাধিকার মুছে ফেলার এক প্রতীকী পদক্ষেপ।

১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সালের স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময়, প্রায় ৩২,০০০ স্বেচ্ছাসেবক বিশ্বের নানা দেশ থেকে এসে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্তর্জাতিক ব্রিগেডে যোগ দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ড থেকে অংশ নেন প্রায় ২,৫০০ জন, যাঁদের মধ্যে ৫৩০ জন যুদ্ধে প্রাণ হারান।

মাদ্রিদে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো স্যাঞ্চেজ নাগরিকদের উদ্দেশে বলেন, “তাদের আমাদের সহনাগরিক বলা আমাদের জন্য এক গৌরবের বিষয়। তারা এক সময় যেভাবে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য লড়েছিলেন, আমরাও আজ একই গণতন্ত্রের সুরক্ষায় সেই সংগ্রাম চালিয়ে যাব।”

এ বছরই স্পেনের স্বৈরশাসক ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর ৫০তম বার্ষিকী। এই উপলক্ষে স্যাঞ্চেজ সরকার অতীতের অন্যায় মুছে ফেলার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। লন্ডনে ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেড মেমোরিয়াল ট্রাস্ট-এর চেয়ারম্যান জিম জাম্প বলেন, “স্পেন সরকারের এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে তারা ফ্রাঙ্কোর বিষাক্ত উত্তরাধিকার মুছে ফেলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। গৃহযুদ্ধের পরও আন্তর্জাতিক ব্রিগেড সদস্যদের পরিবারগুলো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই চালিয়ে গেছে। এই নাগরিকত্ব সেই ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতির পূরণ।”

নাগরিকত্ব প্রাপ্তদের একজন পিটার ক্রোম, একজন অবসরপ্রাপ্ত জেরিয়াট্রিক মেডিসিনের অধ্যাপক। তাঁর পিতা লেন ক্রোম ছিলেন আন্তর্জাতিক ব্রিগেডের চিকিৎসক, যিনি ১৯৩৭ সালে মাদ্রিদের কাছে জারামা এবং পরবর্তী ইব্রো যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করেন। লেন ক্রোম লাটভিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন (তৎকালীন রুশ সাম্রাজ্যের অংশ) এবং ১৯২৬ সালে ব্রিটেনে এসে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা বিদ্যা অধ্যয়ন করেন।

পিটার বলেন, “আমার বাবা আজকের ভাষায় ‘লেফটি’ ছিলেন, কিন্তু কোনও দলের সদস্য ছিলেন না। ফ্যাসিবাদ ও ইহুদি-বিরোধিতার উত্থান তাঁকে গভীরভাবে বিচলিত করেছিল। সেই ভাবনা থেকেই তিনি স্পেনে যান।” লেন ক্রোম ছিলেন বহু ভাষাবিদ—রুশ, জার্মান-সহ একাধিক ভাষায় দক্ষ। তাই তিনি বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা যোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারতেন। ১৯৩৮ সালের শেষ দিকে আন্তর্জাতিক ব্রিগেড প্রত্যাহার হওয়ার সময় তিনি ‘চিফ মেডিক্যাল অফিসার’-এর পদে উন্নীত হন।

যুদ্ধ শেষে ব্রিটেনে ফিরে এসে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চাইলেও “ব্রিটিশ পিতা না থাকার” কারণে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং দেশত্যাগেরও হুমকি দেওয়া হয়। পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁকে চিকিৎসক হিসেবে আবার ডাকা হয় এবং ইতালির মন্টে ক্যাসিনো যুদ্ধে বীরত্বের জন্য সামরিক ক্রস পান।

পিটার বলেন, “এই নাগরিকত্ব অনেক দীর্ঘ সংগ্রামের ফল। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে তখনও জীবিত থাকা আন্তর্জাতিক ব্রিগেড সদস্যদের মধ্যে ২৩ জনকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল। আজ তাঁদের উত্তরসূরিরা সেই ঐতিহ্যের ধারক।”

স্পেন সরকার সম্প্রতি ‘ন্যাশনাল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো ফাউন্ডেশন’-এর কার্যক্রম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে যে তারা “ফ্রাঙ্কোবাদ প্রচার” করছে এবং “গণতান্ত্রিক স্মৃতি আইন”-এর চেতনার পরিপন্থী কাজ করছে। ফাউন্ডেশনকে ১০ দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে, এরপর বিচারিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এছাড়াও, সরকার একটি রাজকীয় অধ্যাদেশের মাধ্যমে স্পেনজুড়ে ফ্যাসিবাদ-পন্থী প্রতীক, নামফলক ও স্মৃতিস্তম্ভ সরানোর ঘোষণা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী স্যাঞ্চেজ বলেন, “যাতে আমাদের শহর, গ্রাম ও চত্বরে আর একটিও স্বৈরাচারের চিহ্ন না থাকে, সে ব্যবস্থা এবার স্থায়ীভাবে নেওয়া হবে।”

এই অনুষ্ঠানে সরকার গৃহযুদ্ধ ও ফ্রাঙ্কো শাসনের শিকার ১৮ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকেও স্মরণ করেছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা—যিনি ১৯৩৬ সালে খুন হন—এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা লুই বুনুয়েল, যিনি নির্বাসিত হয়ে নিজের দেশে সেন্সরশিপের মুখোমুখি হন। কবির ভাগ্নি লরা গার্সিয়া লোরকা বলেন, “আজকের এই স্বীকৃতি শুধু ফেদেরিকোর জন্য নয়, সেই হাজার হাজার নারী-পুরুষের জন্য যারা প্রাণ হারিয়েছেন, বন্দী হয়েছেন, নির্বাসিত বা নীরবতায় দণ্ডিত হয়েছেন।”