আজকাল ওয়েবডেস্ক: অসমের নলবাড়ি জেলার বারকুরা গ্রামের ৬৮ বছরের সাকিনা বেগম চার মাস নিখোঁজ থাকার পর এখন ঢাকার কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। অভিযোগ, তাঁকে ভারতে থেকে বাংলাদেশে বেআইনি ভাবে ‘পুশব্যাক’ করা হয়েছে। ঢাকায় তাঁকে আটক করা হয়েছে ১৯৫২ সালের দ্য কন্ট্রোল অফ এন্ট্রি অ্যাক্ট–এর আওতায়, কারণ তিনি বৈধ পাসপোর্ট–ভিসা দেখাতে পারেননি। সাকিনা ইতিমধ্যে ৫৩ দিন ধরে কারাগারে বন্দি।

সাকিনা বেগমকে গত মে মাসে নলবাড়ির বাড়ি থেকে নিয়ে যায় অসম পুলিশ। পরিবারের দাবি, স্বাক্ষরের প্রয়োজন বলেই তাঁকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু এরপর তাঁকে আর ফেরত আনা হয়নি। কয়েক দিন পরে পরিবার থানায় যোগাযোগ করলে পুলিশ জানায় সাকিনা থানায় নেই। কোথায় গেছেন সে বিষয়ে কোনও স্পষ্ট তথ্য দেয়নি।

এদিকে নিখোঁজ অবস্থায় সাকিনাকে এ বছরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার মিরপুর–ভাষানটেক এলাকার রাস্তার পাশে অসুস্থ অবস্থায় পাওয়া যায়। স্থানীয় বাসিন্দা ৪০ বছর বয়সি জাকিয়া বেগম তাঁকে বাড়িতে নিয়ে যান, চিকিৎসা করান এবং প্রায় চার মাস আশ্রয় দেন। জাকিয়া জানান, চারদিন ঈদুল আজহার আগে তিনি রাস্তার পাশে দোকানের সামনে সাকিনাকে বসে থাকতে দেখেন। ভাষাগত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তিনি বুঝতে পারেন যে বৃদ্ধা মহিলাটি অসহায় অবস্থায় আছেন।

প্রায় ১৫ দিন যত্ন নেওয়ার পর জাকিয়া জানতে পারেন সাকিনা ভারতের অসমের বাসিন্দা। এলাকার মানুষজনকে নিয়ে তিনি চেষ্টা করেন সাকিনার পরিবারকে খুঁজে বের করতে। পরে তাঁরা বিবিসি বাংলা-র এক সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সাকিনার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সাংবাদিকটি নলবাড়িতে খোঁজ চালিয়ে তাঁর পরিবারকে খুঁজে বের করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ার পর ভাষানটেক থানা পুলিশ সাকিনাকে নিজেদের হেফাজতে নেয় এবং আদালতে হাজির করে অভিযোগ আনে যে তিনি বাংলাদেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন।

সাকিনার মেয়ে রাসিয়া বেগম জানান, তাঁর মা বহু বছর ধরে ভারতে নাগরিকত্ব প্রমাণের আইনি লড়াইয়ে জড়িয়ে আছেন। ২০১২ সালে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল সাকিনাকে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করে। এরপর ২০১৬ থেকে তাঁকে কোচবিহার ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হয়। ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জামিনে মুক্তি পেয়ে সাকিনাকে নিয়মিত নলবাড়ি থানায় রিপোর্ট করতে হতো। সর্বশেষ ২৫ মে তিনি থানায় রিপোর্ট করেন। তারপর থেকেই তাঁর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না।

রাসিয়া আরও জানান, পরিবার একপর্যায়ে একটি সহায়তা সংস্থার হেল্পলাইন নম্বরে ফোন করে জানতে পারে—সাকিনাকে ২৬ মে বিএসএফ-এ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স) প্যানবাড়ি, ধুবড়ি সেক্টর সদর দপ্তরে  “হস্তান্তর” করা হয়েছে। সেই সময় অসম সরকার সন্দেহভাজন ‘অবৈধ অভিবাসী’দের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর বা ‘পুশব্যাক’-এর নীতিকে সমর্থন করছিল। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, অন্তত এক হাজার মানুষকে এইভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তবে ভারত সরকার এই বিষয়ে কোনও সরকারি তথ্য প্রকাশ করেনি। বিবিসি যখন বিএসএফের কাছে সাকিনা সম্পর্কে জানতে চায়, কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশের পুলিশ ২৫ সেপ্টেম্বর সাকিনার বিরুদ্ধে দ্য কন্ট্রোল অফ এন্ট্রি অ্যাক্ট, ১৯৫২-এর আওতায় মামলা করে। অভিযোগে বলা হয়েছে—কোনও বৈধ কাগজ দেখাতে না পারায় তাঁকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ধরা হয়েছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাব–ইন্সপেক্টর শেখ মো. আলী সোনি আদালতে আবেদন করে সাকিনাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ চান। শুনানি শেষে আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। জাকিয়ার পক্ষ থেকে মামলাটি লড়ছেন আইনজীবী রহমানউল্লাহ। তিনি জানান, তিনবার জামিনের আবেদন করলেও প্রতিবারই আদালত তা খারিজ করেছে। চিকিৎসার আবেদন গ্রহণ করা হলেও বয়সের কারণে ‘সেফ কাস্টোডি’র আবেদনও নাকচ হয়েছে।

জাকিয়া বেগমের মতো স্বল্প আয়ের একজন গৃহকর্মীর পক্ষে এই আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন। স্থানীয় মানুষের সহায়তায় তিনি এখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর ইচ্ছা—সাকিনাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে নিজের বাড়িতে রাখবেন যতদিন না তাঁকে ভারতে ফেরানো যায়।

অন্যদিকে, অসমে থাকা তাঁর পরিবার ইতিমধ্যে আধার কার্ড-সহ বিভিন্ন নথি জমা দিয়েছে, যেখানে সাকিনার বাবা অসমে ভোটার ছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে। পরিবারের দাবি—এসব সরকারি নথি কোনও বিদেশির পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়। তবুও বাংলাদেশ তাঁকে নিজেদের নাগরিক হিসেবে মানছে না, আবার ভারত বলছে তাঁরা এখনো বিষয়টি ‘অফিশিয়ালি জানে না’। দিল্লিতে ভারতের হাইকমিশন জানায়, “এই বিষয়ে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে অবগত নই। আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হলে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।”

১০ নভেম্বর ঢাকার আদালতে সামান্য কথোপকথনে সাকিনা দিশেহারা চোখে শুধু একটিই প্রশ্ন করেন—তাঁর মেয়ে কেমন আছে? পুলিশ সদস্যরা তাঁকে দ্রুত আদালত কক্ষ থেকে বের করে এনে গাড়িতে তুলে দেয়। ছয় দশকের বেশি বয়সে সাকিনা এখন ভারত ও বাংলাদেশের প্রশাসনিক দ্বন্দ্বের মাঝে আটকে পড়েছেন। একদিকে ভারতের নাগরিকত্ব–সংক্রান্ত বহুবছরের লড়াই, অন্যদিকে বাংলাদেশে অবৈধ প্রবেশের মামলা—দুই দেশের সীমান্ত রাজনীতির বলি হয়ে তাঁর ঘরে ফেরার পথ এখনো অজানা।