আজকাল ওয়েবডেস্ক: বুধবার সকালে অনেকের ফোনে একটি ছোট্ট বার্তা ভেসে উঠেছিল— “মামদানি মুবারক।” প্রথমে অনেকে ভেবেছিলেন, হয়তো কোনও উৎসবের শুভেচ্ছা। কিন্তু না, সেটি ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনার আনন্দবার্তা। চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ার ও বিশিষ্ট চিন্তাবিদ মাহমুদ মামদানির পুত্র জোহরান মামদানি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন— নিউ ইয়র্ক সিটির নতুন মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়ে।

মামদানির জয় শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়, বরং এটি এক গভীর মানবিক প্রতীক। যখন বিশ্বজুড়ে রাজনীতিতে ট্রাম্প, পুতিন বা এরদোগানের মত নেতাদের আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ ছায়া ফেলছে, তখন মামদানির অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রগতিশীল রাজনীতি যেন নতুন আশা জাগায়। অভিবাসীদের উষ্ণ আলিঙ্গন, শ্রমজীবী মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সাধারণ মানুষের কণ্ঠকে সামনে আনা— এই সবই তাঁকে আলাদা করে তুলেছে।

নির্বাচনী প্রচারে তিনি বিলাসবহুল সভা বা কর্পোরেট সমর্থনের উপর নির্ভর করেননি। বরং তিনি ট্যাক্সিচালকদের সঙ্গে লাঞ্চ  করেছেন, সিকিউরিটি গার্ডদের সঙ্গে কফি খেয়েছেন, শ্রমজীবী কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এই দৃশ্য যেন মনে করিয়ে দেয়— পৃথিবী এখনও সম্পূর্ণভাবে বিলিয়নিয়ার ও বেজোসদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। এখনও জায়গা আছে সমাজতন্ত্রী, দরিদ্র, প্রান্তিক ও নিপীড়িতদের জন্য।

নিউ ইয়র্কের মানুষ বহুদিন ধরে এমন এক নেতার অপেক্ষায় ছিলেন, যিনি তাদের শহরের প্রকৃত চিত্রকে প্রতিফলিত করবেন— শুধু আকাশচুম্বী ভবনের নয়, বরং তার আর্ট, সঙ্গীত, খাবার ও মেট্রোর স্পন্দনের। মামদানি সেই আত্মাকে প্রতিনিধিত্ব করছেন, সেই “ড্যান হামফ্রেস”-এর নিউ ইয়র্ককে, যিনি মূল গল্পের মেরুদণ্ড।

মামদানির জয় ইসলামোফোবিয়ায় জর্জরিত আমেরিকার জন্য এক শক্তিশালী বার্তা। তিনি কখনও নিজের পরিচয় আড়াল করেননি। ভোটারদের অভ্যর্থনা জানিয়েছেন “আসসালামু আলাইকুম” বলে, ধর্মীয় পরিচয় ঢেকে রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি। এই সততা ও আত্মবিশ্বাসই তাঁকে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দিয়েছে।

তিনি ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর গাজা নীতির সমালোচনা করেছেন, যেমন তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা নিয়েও সরব হয়েছিলেন। উল্লেখযোগ্যভাবে, তাঁর পিতা মাহমুদ মামদানি মূলত গুজরাটের মানুষ, যিনি পরবর্তীতে উগান্ডায় অভিবাসন করেন।

মামদানির তুলনায় প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অনেক বেশি “নিরাপদ” রাজনীতি করেছেন— নিজের মধ্য নাম “হুসেইন” প্রচারণা থেকে সরিয়ে রেখে। তাই মামদানিকে আজকের প্রজন্ম প্রকৃত নায়ক হিসেবে দেখছে। জেন জি প্রজন্মের মধ্যে তিনি এখন এক নয়া আইকন— তাঁর বিনয়, সাধারণ জীবনযাপন, মেট্রোযাত্রা, ও রাতের শিফটের শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপচারিতা তাঁকে করে তুলেছে “মানবিক রাজনীতির” প্রতীক।

একজন তরুণ ভারতীয় নারী হিসেবে, যিনি প্রতিনিয়ত ধর্ম ও জাতপাতের রাজনীতিতে ক্লান্ত, মামদানির জয় ব্যক্তিগতও বটে। তাঁর বক্তৃতায় জওহরলাল নেহরুর উদ্ধৃতি শোনা গিয়েছে— এক স্মরণীয় মুহূর্ত, যা মনে করিয়ে দেয়, আজও ভারতের জন্য নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষ, বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি কতটা প্রাসঙ্গিক।

৯/১১–এর ২৪ বছর পর, আমেরিকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক মুসলিম অভিবাসীর পুত্রের এমন জয়— সত্যিই এক নতুন ইতিহাস। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়— ভারত কি এরকম কিছু কল্পনা করতে পারে? গুজরাটে কোনও মুসলিম মুখ্যমন্ত্রী, ১৯৮৪–এর পর দিল্লিতে কোনও শিখ মুখ্যমন্ত্রী, বা মুম্বইয়ে কোনও মুসলিম মেয়র? যখন বিজেপি নেতা অমিত সাতম প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, “আমরা কোনও ‘খান’-কে মেয়র হতে দেব না,” তখন ভারতের গণতন্ত্রের আয়না আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

মামদানির জয়ের মধ্যে যেমন রাজনীতি আছে, তেমনই আছে মানবতার দীপ্তি। বিলাসবহুল প্রচারের প্রয়োজন ছাড়াই তাঁর শান্ত, বিনয়ী ব্যক্তিত্ব আজ কোটি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। আর শেষে, তাঁর বিজয়-উৎসবের মুহূর্ত— যখন তিনি “ধুম মাচালে” গানের তালে মঞ্চ ছাড়লেন, যেন মহাবিশ্বই বলল, “বিশ্বের তাল এখনও জীবিত।”

যখন ইন্টারনেট নস্টালজিয়ায় ভাসছে, কাইলি জেনার ফিরিয়ে আনছেন “কিং কাইলি” যুগ, মামদানির জয় স্মরণ করিয়ে দেয়— হয়তো পৃথিবী ধীরে ধীরে সেরে উঠছে। সম্ভবত ২০২৬ হবে ২০০৮–এর এক নবজন্ম, এক সাহসী, মানবিক পৃথিবীর, যেখানে নেতৃত্বের মানে হবে— পৃথিবী সবার জন্য সমানভাবে বাসযোগ্য করে তোলা।