আজকাল ওয়েবডেস্ক: জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে ফের বিতর্কে জড়ালেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগকে তিনি আখ্যা দিলেন “পূর্ণ উন্মাদনা”। একইসঙ্গে তিনি হামাস, হিজবুল্লাহ ও হুথিদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা করেন এবং ইরানকে সন্ত্রাসের “অভিশাপ” বলে চিহ্নিত করেন।
কিন্তু তাঁর এই বক্তৃতা ঘিরে জাতিসংঘ ভবনের ভেতরে ও বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই দেখা দিল চরম প্রতিক্রিয়া। নেতানিয়াহু বক্তৃতা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই একাধিক দেশের কূটনীতিকরা হল ছেড়ে বেরিয়ে যান। ফলে নিচতলার আসন সারি ফাঁকা হয়ে পড়ে। উল্টো দিকে উপরের ব্যালকনিতে তাঁর সমর্থক অতিথিদের হাততালিতে প্রতিধ্বনিত হয় প্রেক্ষাগৃহ। কেউ কেউ চিৎকার করে সমর্থন জানালেও, একইসঙ্গে শোনা গিয়েছে কটূক্তি ও বাঁশি বাজানো। জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্তেফাঁ দুজারিক এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নে শুধু বলেন— “প্রতিটি দেশই নিজস্ব অতিথি নিয়ে আসতে পারে।”
ভাষণ শুরুর আগে থেকেই হাজার হাজার নিউ ইয়র্কবাসী জাতিসংঘের বাইরে বিক্ষোভ শুরু করেন। Palestine Youth Movement – NYC সহ একাধিক সংগঠন এই মিছিলে অংশ নেয়। টাইমস স্কোয়ার থেকে ইস্ট রিভারের ধারে জাতিসংঘ কমপ্লেক্স পর্যন্ত মিছিল চলে। বিক্ষোভকারীদের হাতে ছিল নানা পোস্টার ও প্ল্যাকার্ড। এক নিউ ইয়র্কার মেগান ফ্রেডেট হাতে তুলে নেন একটি পোস্টার— “Is baby formula Hamas???”— যা গাজার উপর খাদ্যনিষেধাজ্ঞাকে ব্যঙ্গ করে।
বিক্ষোভ প্রদর্শনকারীদের অভিযোগ, প্রায় দুই বছর ধরে ইজরায়েলি হামলায় গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষে শিশু-মৃত্যু বেড়েই চলেছে। আল-শরীফ নাসেফ নামে এক বিক্ষোভকারী জানান, “নেতানিয়াহুর থাকার জায়গা নিউ ইয়র্ক নয়, দ্য হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত।”
আরও পড়ুন: ইতালিতে ১০ লক্ষ মানুষের সাধারণ ধর্মঘট: প্যালেস্তাইনের পাশে দাঁড়াল শ্রমিকরা
গত বছর আইসিসি নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল। নিউ ইয়র্কের ডেমোক্র্যাটিক মেয়র প্রার্থী জোহরান মামদানি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি ক্ষমতায় এলে সেই পরোয়ানা কার্যকর করার চেষ্টা করবেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্য নয়, ফলে আইনগত জটিলতা থেকেই যাচ্ছে।
ভাষণের পর তাঁর দপ্তরের দাবি, ইজরায়েলি সেনারা গাজাবাসীর ফোন হ্যাক করে জোর করে তাঁর ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করেছে। এমনকি লাউডস্পিকারে ভাষণ বাজানো হয়েছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নে জাতিসংঘের মুখপাত্র দুজারিক কোনো মন্তব্য করতে চাননি, তবে বলেন, “মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত প্যালেস্তিনীয়দের দুর্ভোগ লাঘব ও মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া।”
জাতিসংঘ অধিবেশনের সমান্তরালে ৩৪ দেশের কূটনীতিক ‘হেগ গ্রুপ’-এর বৈঠকে মিলিত হন। দক্ষিণ আফ্রিকা, কলম্বিয়া, আয়ারল্যান্ড, মেক্সিকো, সৌদি আরব, তুরস্ক, ব্রাজিল, স্পেনসহ একাধিক দেশ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপের আহ্বান জানায়।
প্যালেস্টাইনের জাতিসংঘ প্রতিনিধি রিয়াদ মানসুর বলেন, “সময় ফুরিয়ে আসছে। প্রতিটি দিন শিশুদের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।” তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার উত্থাপিত গণহত্যার মামলা আন্তর্জাতিক আদালতে সমর্থনের আহ্বান জানান। ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাউরো ভিয়েরা সতর্ক করে বলেন, “গণহত্যা ঠেকানো প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তা না হলে রাষ্ট্রগুলিরও সহযোগী হিসেবে দায়বদ্ধতা তৈরি হবে।”
জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ইজরায়েলি হামলায় গাজায় অন্তত ৬৫ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার শিশু। আন্তর্জাতিক মহলে ক্ষোভ বাড়তে থাকায় ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যসহ একাধিক পশ্চিমা দেশ এবার ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। জাতিসংঘে নেতানিয়াহুর বক্তব্য যেমন ইজরায়েলি সমর্থকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে, তেমনি বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ ও প্রতিরোধ আন্দোলনকে আরও উস্কে দিয়েছে। নিউ ইয়র্কের রাস্তায় বিক্ষোভ, ৩৪ দেশের কূটনৈতিক পদক্ষেপের আহ্বান এবং আইসিসি গ্রেপ্তারি পরোয়ানার প্রেক্ষাপটে তাঁর এই সফর কূটনৈতিকভাবে আরও জটিল হয়ে উঠছে।
