আজকাল ওয়েবডেস্ক: পৃথিবী যখন নতুন করে চাঁদের দিকে যাত্রা শুরু করছে। তখন এক অনিবার্য বিপদ মাথাচাড়া দিচ্ছে: উল্কাপিণ্ডের আঘাত। অক্টোবরের শেষ রাতে সেই আশঙ্কার এক জীবন্ত উদাহরণ ধরা পড়ল, যা জ্যোতির্বিদদের মুগ্ধ করেছে এবং বিজ্ঞানীদের নতুন করে সতর্ক করেছে।
চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর রাতে এক বিশাল বস্তু চাঁদের বুকে আছড়ে পড়ে, সৃষ্টি করে চোখ-ধাঁধানো বিস্ফোরণ। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সেই মুহূর্তের আলো পৃথিবী থেকেও দেখা গেছে। এই বিরল ঘটনাটি ভিডিওতে ধারণ করেন জাপানি জ্যোতির্বিজ্ঞানী দাইচি ফুজি। তিনি তাঁর টেলিস্কোপে ২০:৩৩:১৩.৪ সময়ের এই মুহূর্ত রেকর্ড করেন প্রতি সেকেন্ডে ২৭০ ফ্রেম গতিতে। পরে ভিডিওটি ০.০৩x ধীর গতিতে চালানো হলে স্পষ্ট দেখা যায়—চাঁদের অন্ধকার পৃষ্ঠে হঠাৎ এক উজ্জ্বল আলোর ঝলক, যা ছিল এক নতুন গহ্বরের জন্মমুহূর্ত।


পৃথিবীর মতো চাঁদের কোনো বায়ুমণ্ডল নেই। তাই সেখানে উল্কাপিণ্ড প্রবেশ করলে ‘শুটিং স্টার’-এর মতো আলোর রেখা তৈরি হয় না। বরং সরাসরি আঘাত হেনে তাৎক্ষণিকভাবে প্রচণ্ড শক্তি মুক্তি দেয়, সৃষ্টি করে নতুন ক্রেটার বা গহ্বর। এই বিশেষ আঘাতটি ঘটেছে গাসেন্ডি ক্রেটারের পূর্বদিকে—চাঁদের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি বিখ্যাত অঞ্চল।


বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই আঘাতটি সম্ভবত টরিড উল্কাপাত প্রবাহের অন্তর্গত কোনো উল্কাপিণ্ডের কারণে ঘটেছে। প্রতি বছর অক্টোবর-নভেম্বর মাসে উত্তর ও দক্ষিণ টরিড উল্কাপাত পৃথিবীর কাছাকাছি অঞ্চলে সক্রিয় থাকে। এসব উল্কাপিণ্ড প্রায় ২৭ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড বেগে এবং প্রায় ৩৫ ডিগ্রি কোণে চাঁদের পৃষ্ঠে এসে আঘাত হানে। প্রাথমিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ওই উল্কাপিণ্ডটির ওজন ছিল প্রায় ২০০ গ্রাম (০.২ কিলোগ্রাম) এবং আঘাতে প্রায় তিন মিটার ব্যাসের একটি গহ্বর তৈরি হয়। বিস্ফোরণের উজ্জ্বলতা ছিল প্রায় ৮তম মানের এবং স্থায়িত্ব মাত্র ০.১ সেকেন্ড।


এই সংক্ষিপ্ত অথচ তীব্র আলোঝলক আমাদের মনে করিয়ে দেয়—চাঁদ আজও ক্রমাগত মহাজাগতিক বস্তুর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব আঘাতই চাঁদের চেহারাকে নতুন করে গড়ে তুলছে। বিজ্ঞানীরা এখন আগ্রহভরে অপেক্ষা করছেন নাসার লুনার রিকনেসান্স অরবিটারের তোলা ছবির জন্য, যাতে নতুন গহ্বরটির অবস্থান ও আশেপাশের পরিবর্তনগুলি স্পষ্টভাবে দেখা যাবে।


ফুজির এই ভিডিও এখন জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে নতুন সংযোজন। অপেশাদার ও পেশাদার উভয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত পর্যবেক্ষণের ফলে এখন নিয়মিতভাবে এমন চন্দ্র আঘাত ধরা পড়ছে, যা উল্কাপাত প্রবাহের গতি, আকার ও প্রভাব বোঝার ক্ষেত্রে অমূল্য তথ্য দিচ্ছে। ভবিষ্যতের চন্দ্র মিশনের জন্য এই তথ্যগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—বিশেষ করে যখন মানুষ চাঁদে স্থায়ী ঘাঁটি তৈরি করতে যাচ্ছে। এসব পর্যবেক্ষণই বিজ্ঞানীদের সাহায্য করবে বুঝতে, কীভাবে উল্কাপিণ্ডের ঝুঁকি থেকে নভোচারী ও মহাকাশযানকে সুরক্ষিত রাখা যায়।


পৃথিবীর তারামুগ্ধ পর্যবেক্ষকদের কাছে এই দৃশ্য ছিল এক মহাজাগতিক বিস্ময়। ক্ষণিকের এই আলোকচ্ছটা যেন চাঁদের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা—একই সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেয়, আমাদের নিকটতম মহাজাগতিক প্রতিবেশী এখনো জীবন্ত, গতিশীল ও পরিবর্তনশীল।