আজকাল ওয়েবডেস্ক: সম্প্রতি আকাশ থেকে নেমে আসা উজ্জ্বল লাল রঙের আলো দেখে অনেকের মনেই ভিনগ্রহী কার্যকলাপের জল্পনা তৈরি হয়েছিল। তবে বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, এগুলি এলিয়েন নয়, বরং অত্যন্ত বিরল এক ধরনের উচ্চবায়ুমণ্ডলীয় বজ্রপাত, যাকে বলা হয় ‘স্প্রাইটস’।


নাসার ‘স্প্রিটাকুলার’ সিটিজেন সায়েন্স প্রজেক্ট-এর মাধ্যমে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি নতুন ছবিতে এই অদ্ভুত লাল আলোর ঝলক ধরা পড়েছে। ছবিটি তুলেছেন নিকোলা এসকুরা নামের এক অবদানকারী। সেখানে দেখা যাচ্ছে, একটি শক্তিশালী বজ্রপাতের মেঘের উপরে মুহূর্তের জন্য উদ্ভাসিত এক লাল আভা। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্লভ ও রহস্যময় বৈদ্যুতিক ঘটনাগুলোর অন্যতম।


এই ছবি নতুন করে আলোচনায় এনেছে স্প্রাইটস নিয়ে আগ্রহ। কারণ, এই আলো সাধারণত কয়েক মিলিসেকেন্ডের বেশি স্থায়ী হয় না এবং বেশিরভাগ সময় ঝড়ের মেঘের আড়ালেই থেকে যায়, যে ঝড় থেকেই আসলে এদের উৎপত্তি।


স্প্রাইটস দেখতে কেমন
স্প্রাইটস সাধারণত শক্তিশালী বজ্রপাতের অনেক উপরে আকাশে দেখা যায়। এগুলি প্রায়শই খাড়া লাল স্তম্ভের মতো, আবার কখনও জেলিফিশের আকৃতির মতোও দেখা যায়। অনেক সময় একসঙ্গে গুচ্ছ গুচ্ছ স্প্রাইটস তৈরি হয়, যা ঝড়ের মেঘের ওপর ঝুলে থাকার মতো মনে হয়।
স্প্রাইটসের উপরের অংশে থাকে লালচে-কমলা আলো, আর নিচের দিকে থাকা শাখা বা ‘টেন্ড্রিল’-গুলিতে হালকা নীলাভ আভা দেখা যেতে পারে। এতে মনে হয় যেন উজ্জ্বল শিকড় আকাশ থেকে নেমে মেঘের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।


সাধারণ বজ্রপাত যেখানে মেঘের ভেতরে বা মাটি পর্যন্ত আঘাত হানে, সেখানে স্প্রাইটস ঘটে পৃথিবীর মেসোস্ফিয়ার স্তরে, যা ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫০ থেকে ৯০ কিলোমিটার ওপরে। এই অঞ্চলটি বায়ুমণ্ডলের অত্যন্ত পাতলা অংশ।


অত্যন্ত শক্তিশালী বজ্রপাত হঠাৎ করে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রকে উপরের দিকে বিকৃত করে তোলে। এর ফলেই মহাকাশের প্রান্তে এক মুহূর্তের জন্য তৈরি হয় এই নাটকীয় বৈদ্যুতিক ডিসচার্জ—স্প্রাইটস।


কেন এত রহস্যময় মনে হয়
স্প্রাইটস আসলে “ট্রান্সিয়েন্ট লুমিনাস ইভেন্টস” নামে পরিচিত বৃহত্তর এক শ্রেণির অংশ, যার মধ্যে রয়েছে ব্লু জেটস-এর মতো ঘটনাও। এদের সকলের উৎস বজ্রঝড় হলেও, এগুলি মেঘের ভেতরে নয়, মেঘের অনেক ওপরে সংঘটিত হয়।


দীর্ঘদিন ধরে পাইলটরা ঝড়ের ওপর আকাশে অদ্ভুত লাল ঝলক দেখার কথা জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু প্রথম স্পষ্ট ছবি ধরা পড়ে মাত্র ১৯৮৯ সালে। এরপর মহাকাশচারী ও উচ্চমানের ক্যামেরার সাহায্যে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, এই ঘটনাগুলি আগের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি ঘন ও জটিল।


২০২৫ সালের ৩ জুলাই, নাসার মহাকাশচারী নিকোল আইয়ার্স আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS) থেকে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা এক বিশাল আলোর স্তম্ভের ছবি তোলেন। সেটিও ছিল এক বিরল স্প্রাইটস ঘটনা।


এর আগে, ২০২২ সালের ১৯ মে, তিব্বতের দক্ষিণাঞ্চলে পুমোয়ংচু হ্রদের কাছে দুই শৌখিন আলোকচিত্রী একসঙ্গে ১০৫টি লাল আলোর স্তম্ভ ধারণ করেন। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় চীনের বায়ুমণ্ডলীয় বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন, এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার একক ঝড়ের ওপর এখনও পর্যন্ত রেকর্ড হওয়া সবচেয়ে বড় স্প্রাইটস বিস্ফোরণ।


এই সব আবিষ্কার প্রমাণ করছে, আকাশের এই রহস্যময় লাল আলো ভিনগ্রহীদের বার্তা নয়, বরং পৃথিবীর নিজস্ব, এখনও অনেকটাই অজানা এক বৈজ্ঞানিক বিস্ময়।