আজকাল ওয়েবডেস্ক: প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিল যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, পর্তুগাল, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, আন্দোরা প্রভৃতি পশ্চিমী দেশ। ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ২৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই স্বীকৃতির ঢেউ আন্তর্জাতিক পরিসরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। মঙ্গলবার সান মারিনোও প্যালেস্তাইনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা করে। এর ফলে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য দেশের মধ্যে ১৫৯টি দেশ প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিল—যা মোট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—এটি কি কেবল প্রতীকী পদক্ষেপ, নাকি প্যালেস্তাইনের দীর্ঘ সংগ্রামের ন্যায্য সমাধানের পথে প্রকৃত অগ্রগতি?
প্যালেস্তিনি কর্তৃপক্ষ (PA) পশ্চিমী দেশগুলির এই পদক্ষেপকে ‘ঐতিহাসিক’ ও ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বলে আখ্যা দিয়েছে। রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাস ধন্যবাদ জানিয়েছেন যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, পর্তুগাল, ফ্রান্স, মাল্টা, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ ও আন্দোরাকে। আব্বাস বলেছেন, এটি “ন্যায্য ও স্থায়ী শান্তির পথে অগ্রসর হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।”
তবে গাজার রক্তাক্ত বাস্তবতা এই স্বীকৃতিকে আড়াল করে দিয়েছে। গত কয়েক বছরে ইজরায়েলের আগ্রাসী সামরিক অভিযান ও অবরোধে অন্তত ৬৫,৫০০ প্যালেস্তিনি নিহত হয়েছেন, প্রায় ২০ লাখ মানুষ গৃহহীন ও অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রকের মহাপরিচালক ড. মুনির আল-বুর্শ এই স্বীকৃতিকে কটাক্ষ করে বলেছেন—“একজন রোগী অপারেশন থিয়েটারে রক্তে ভেসে যাচ্ছে, আর ডাক্তার তার আইডি কার্ড যাচাই করছে—এটাই আজকের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ছবি।”
১৯৪৮ সালে ইজরায়েলি দখলদার বাহিনীর হাতে দেশছাড়া লক্ষ লক্ষ প্যালেস্তিনি ও তাঁদের উত্তরসূরিদের ‘ফিরে আসার অধিকার’ এই স্বীকৃতিতে একেবারেই নারাজ। জাতিসংঘের UNRWA-এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে লিখিতভাবে প্যালেস্তিনি শরণার্থীর সংখ্যা ৫.৯ মিলিয়ন। বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বেশি। প্যালেস্তিনিদের মতে, এই শরণার্থীদের অধিকার ছাড়া কোনো স্বীকৃতি ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না।
আরও পড়ুন: দেশ কে চালায়, সেনা না সরকার? উত্তরে পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী যা বললেন, উত্তরে বিভ্রান্তি আরও বাড়ল
পশ্চিম তীরের সাংবাদিক হাফেজ আবু সাবরা সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন—“আমার দাদাকে লড থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল, তিনি জাফার পাশ থেকে গাজায়, তারপর নাবলুসে এসে থিতু হন। আমাদের প্রজন্ম জন্ম থেকে ‘স্বাধীন প্যালেস্তাইন’ বলে স্লোগান দিয়েছে। পশ্চিমীদের স্বীকৃতির অপেক্ষায় আমরা কখনও ছিলাম না, আজও নেই।”
অন্যদিকে কর্মী আমিনা খন্দাকজি তীব্র ক্ষোভে বলেন—“তোমরা আগেই বলে দিতে পারতে যে, অন্তত ৬০ হাজার প্যালেস্তিনির রক্ত দরকার হবে তোমাদের সহানুভূতি জাগাতে। আমাদের সেরা তরুণদের হারাতে হবে, তবেই তোমরা প্রতীকী স্বীকৃতি দেবে?”
বাস্তবে প্যালেস্তাইন এখনও বিভক্ত ভূমিখণ্ডে সীমাবদ্ধ। পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন, সামরিক চৌকি, সীমান্ত বন্ধ—সবই ইজরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। প্যালেস্তাইনের নেই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, নেই সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের স্বাধীনতা। স্বীকৃতি পাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইজরায়েল কিং হুসেইন সেতু (অ্যালেনবি ব্রিজ) বন্ধ করে দিল, ফলে শীর্ষ প্যালেস্তিনি কর্মকর্তারাও আটকা পড়লেন।
পশ্চিমী দেশগুলির স্বীকৃতিতে একাধিক শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান—সম্ভাব্য প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রকে ‘নিরস্ত্র’ থাকতে হবে, এবং হামাসকে বাদ দিতে হবে। প্যালেস্তিনি আন্দোলনের দাবি, এটি আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী, কারণ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে মুক্তিসংগ্রাম তাদের স্বীকৃত অধিকার।
সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়েছে যুক্তরাজ্য। ১৯১৭ সালের ব্যালফোর ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটেন প্যালেস্তাইনে ‘ইহুদি জাতীয় স্বদেশ’ প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দিয়েছিল। প্যালেস্তিনিদের মতে, তাদের দীর্ঘ ১০৮ বছরের দুঃসহ যন্ত্রণার জন্য ব্রিটেন সবচেয়ে বড় দায়ী। তাই ব্রিটেনের শর্তযুক্ত, প্রতীকী স্বীকৃতি প্যালেস্তিনিদের চোখে নতুন করে ক্ষত জাগিয়েছে।
পশ্চিমী দেশগুলির সাম্প্রতিক স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে একটি মাইলফলক। তবে প্যালেস্তাইনের জনগণের জন্য এটি এখনো কোনো বাস্তব স্বস্তি বয়ে আনেনি। শরণার্থী সংকট, চলমান গণহত্যা, দখলদারিত্ব, সীমান্ত অবরোধ—সবকিছু অপরিবর্তিত। প্যালেস্তিনি তৃণমূল কর্মীদের মতে, যতক্ষণ না ইজরায়েলি দখলদারিত্ব শেষ হচ্ছে, শরণার্থীদের ফেরার অধিকার কার্যকর হচ্ছে এবং প্যালেস্তাইন পূর্ণ সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে, ততক্ষণ এই স্বীকৃতি নিছক “প্রতীকী।” আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি দেশ আজ প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার মাটিতে প্যালেস্তিনি জনগণ এখনও আগের মতো রক্ত, ক্ষুধা ও নির্বাসনের মধ্যে বেঁচে আছেন। তাই এই স্বীকৃতি—আসলেই কি ন্যায্য সমাধানের পথে অগ্রগতি, নাকি কেবল এক প্রতীকী অভিনয়—সেই প্রশ্ন আজও ঝুলে রইল।
