আজকাল ওয়েবডেস্ক: আট মাস নীরবতার পর অবশেষে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর আওতায় চালানো নির্ভুল ও কৌশলগত হামলার প্রভাব স্বীকার করল পাকিস্তান সরকার। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও বিদেশমন্ত্রী ইসহাক দার প্রথমবারের মতো বিস্তারিতভাবে মেনে নিলেন যে, ২০২৫ সালের মে মাসে ভারতের ড্রোন হামলায় রাওয়ালপিন্ডির চাকলালা এলাকায় অবস্থিত নূর খান বিমানঘাঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পাকিস্তানি সেনাকর্মীরা আহত হন।
গত সপ্তাহে বর্ষশেষের সাংবাদিক সম্মেলনে দার বলেন, “মাত্র ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ৮০টি ড্রোন পাঠানো হয়েছিল।” যদিও তিনি দাবি করেন, পাকিস্তান এর মধ্যে ৭৯টি ড্রোন নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়। তবে একই সঙ্গে তিনি স্বীকার করেন, “ভারত ১০ মে ভোরে নূর খান বিমানঘাঁটিতে হামলা চালানোর ভুল করে, যার ফলে পাকিস্তান পাল্টা অভিযান শুরু করতে বাধ্য হয়।”
উল্লেখ্য, ভারত ২০২৫ সালের ৭ মে ভোররাতে ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করে। এর পেছনে ছিল ২৬ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পহেগাওঁ-এ সন্ত্রাসীদের হাতে ২৬ জন নিরীহ নাগরিকের নৃশংস হত্যাকাণ্ড। ওই হামলার প্রতিশোধ হিসেবেই ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে নির্দিষ্ট সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে।
ইসহাক দারের এই বক্তব্য পাকিস্তানের পূর্ববর্তী অবস্থানের সঙ্গে স্পষ্টভাবে বিপরীতমুখী। এতদিন ইসলামাবাদ ভারতের হামলায় ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি কার্যত অস্বীকার বা খাটো করে দেখিয়ে এসেছে। কিন্তু এবার নূর খান বিমানঘাঁটিতে ক্ষতির কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করায় বিষয়টি নতুন মাত্রা পেল।
দার আরও দাবি করেন, মে মাসের সংঘাত চলাকালীন পাকিস্তান কখনও ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্থতার অনুরোধ জানায়নি। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং সৌদি আরবের বিদেশমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান নিজেরাই নয়াদিল্লির সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। দারের দাবি, ১০ মে সকাল ৮টা ১৭ মিনিটে রুবিও তাঁকে ফোন করে জানান যে ভারত যুদ্ধবিরতিতে রাজি এবং জানতে চান পাকিস্তান সম্মত কি না।
“আমি বলেছিলাম, আমরা কখনও যুদ্ধ চাইনি,” বলেন দার। তাঁর মতে, পরে সৌদি বিদেশমন্ত্রীও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে ভারতের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি চান এবং এরপরই নিশ্চিত করেন যে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়েছে।
তবে এই স্বীকারোক্তির মধ্যেও দার বিতর্কিত দাবি তুলতে ভোলেননি। তিনি আবারও বলেন যে, ৭ মে’র আকাশযুদ্ধে পাকিস্তান সাতটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছে যার পক্ষে কোনও প্রমাণ তিনি দেননি। পাশাপাশি তিনি পুনরায় পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় স্থায়ী শান্তি আসতে পারে কেবল জম্মু ও কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের মাধ্যমেই।
এই প্রেক্ষাপটে আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির সাম্প্রতিক মন্তব্য। তিনি প্রকাশ্যে জানান, মে মাসে চার দিনের সংঘাত শুরু হওয়ার পর তাঁর সামরিক সচিব তাঁকে বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
এক জনসভায় জারদারি বলেন, “তিনি এসে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, চলুন বাঙ্কারে যাই।’ আমি বলেছিলাম যদি শহিদ হওয়াই নিয়তি হয়, তবে এখানেই হবে। নেতা বাঙ্কারে মারা যান না, তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রেই মারা যান।” তাঁর এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, ভারতের হামলার পর ইসলামাবাদের ক্ষমতার কেন্দ্রগুলিতে কতটা উচ্চমাত্রার সতর্কতা ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল।
জারদারি আরও দাবি করেন, তিনি নাকি যুদ্ধের সম্ভাবনার কথা চার দিন আগেই জানতেন।
এদিকে সম্প্রতি প্রকাশিত স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যাচ্ছে, নূর খান বিমানঘাঁটিতে পুনর্গঠনের কাজ চলছে। যা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সময় ঘাঁটিটি উল্লেখযোগ্য ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। ইসলামাবাদ থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই বিমানঘাঁটি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অন্যতম কৌশলগত কেন্দ্র, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সম্পদ মজুত থাকে।
ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কোন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিল, তা এখনও নিশ্চিত করেনি। তবে সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, নূর খান ঘাঁটিতে আঘাত হানতে ভারত সম্ভবত ব্রহ্মোস সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল, ফরাসি তৈরি স্কাল্প (SCALP) এয়ার-লঞ্চড ল্যান্ড অ্যাটাক মিসাইল, অথবা উভয়ই ব্যবহার করেছে। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সময় ব্রহ্মোস নিক্ষেপ করা হয় ভারতীয় বায়ুসেনার সু-৩০ যুদ্ধবিমান থেকে এবং স্কাল্প ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয় রাফাল যুদ্ধবিমান থেকে।
সব মিলিয়ে, ইসহাক দারের স্বীকারোক্তি শুধু পাকিস্তানের সরকারি অবস্থানের বড় পরিবর্তনই নয়, বরং ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সামরিক ও কৌশলগত প্রভাব যে ইসলামাবাদ গভীরভাবে অনুভব করেছে, তারও স্পষ্ট প্রমাণ।
