আজকাল ওয়েবডেস্ক: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির ইঙ্গিত দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফ্লোরিডায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকের পর রবিবার ট্রাম্প জানান, শান্তি আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, যদিও ভূখণ্ড সংক্রান্ত জটিল প্রশ্ন এখনও পুরোপুরি মেটেনি।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, “আমি সত্যিই মনে করি আমরা অনেকটাই কাছাকাছি চলে এসেছি, হয়তো খুবই কাছাকাছি।”
অন্যদিকে, জেলেনস্কি এই আলোচনাকে আখ্যা দেন “খুবই চমৎকার ও ফলপ্রসূ” বলে। তাঁর দাবি, ইউক্রেনের জন্য মার্কিন নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে “১০০ শতাংশ ঐকমত্য” হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ট্রাম্প তুলনামূলকভাবে কিছুটা সংযত প্রতিক্রিয়া দেন।
জেলেনস্কি বলেন, “স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন, এ বিষয়ে আমরা একমত।”
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট আরও জানান, আগামী মাসে ট্রাম্প ইউক্রেন ও ইউরোপীয় নেতাদের নিয়ে একাধিক বৈঠকের আয়োজন করবেন, যেখানে শান্তি পরিকল্পনাকে আরও চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হবে।
তবে আলোচনার অমীমাংসিত বিষয় কী- এই প্রশ্নে ট্রাম্প স্পষ্ট করে বলেন, মূল সমস্যা “ভূখণ্ড”। তিনি বলেন, “কিছু জমি ইতিমধ্যেই দখল হয়ে গেছে। কিছু জমি এখনও আলোচনার বিষয় হতে পারে, কিন্তু আগামী কয়েক মাসে সেগুলিও দখল হয়ে যেতে পারে। তাই এখনই চুক্তি করাই ভালো।”
এর আগে রবিবারই নিজের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ ট্রাম্প জানান, জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকের আগে তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একটি “ভালো ও অত্যন্ত ফলপ্রসূ” টেলিফোন কথোপকথন করেছেন। ট্রাম্প আরও বলেন, জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক শেষ হওয়ার পর তিনি আবারও পুতিনকে ফোন করবেন।
এই উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে ট্রাম্পের ফ্লোরিডার মার-আ-লাগো রিসর্টে, এক এমন সময়ে, যখন ২০২২ সালের শুরুতে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের মাধ্যমে শুরু হওয়া প্রায় চার বছরের যুদ্ধ অবসানের প্রচেষ্টা নতুন গতি পাচ্ছে।
রবিবার সকালে ফ্লোরিডায় পৌঁছনো জেলেনস্কি আগেই জানিয়েছিলেন, ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনায় অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা চুক্তির পাশাপাশি সেই “ভূখণ্ড সংক্রান্ত প্রশ্নগুলি” গুরুত্ব পাবে, যা রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সবচেয়ে বড় অচলাবস্থা তৈরি করেছে।
জেলেনস্কি সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, প্রস্তাবিত ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা প্রায় ৯০ শতাংশ প্রস্তুত। তবে এই চুক্তি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। আলোচনার পথে প্রধান বাধাগুলির মধ্যে রয়েছে ডনবাস অঞ্চল নিয়ে রাশিয়ার দাবি, ইউক্রেনের জন্য মার্কিন নিরাপত্তা নিশ্চয়তা এবং ইউরোপের বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভবিষ্যৎ।
এদিকে সাম্প্রতিক মাসগুলিতে যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রগতি দাবি করেছে মস্কো। রাশিয়ার বক্তব্য, তারা পূর্ব ইউক্রেনের আরও অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনেছে। রুশ কর্তৃপক্ষ বারবার দাবি করেছে, ইউক্রেনকে সম্পূর্ণ ডনবাস অঞ্চল ছেড়ে দিতে হবে এমনকি যেসব অংশ এখনও কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেগুলিও।
শনিবার রাশিয়া ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ-সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। রয়টার্সের খবর অনুযায়ী, এতে রাজধানীর একাধিক এলাকায় বিদ্যুৎ ও তাপ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জেলেনস্কি এই হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় চলা শান্তি প্রচেষ্টার প্রতি রাশিয়ার ‘জবাব’ বলে মন্তব্য করেছেন।
শান্তি প্রস্তাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে বিতর্কিত অঞ্চল রাশিয়াকে ছেড়ে দেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে ইউক্রেনে গণভোটের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি ডনবাস অঞ্চলের প্রধান শহর ডোনেৎস্ককে কেন্দ্র করে একটি “ফ্রি ইকোনমিক জোন” গঠনের প্রস্তাবও রয়েছে।
জেলেনস্কি রবিবার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘এক্স’-এ লেখেন, “এই মুহূর্তে বছরের সবচেয়ে সক্রিয় কূটনৈতিক দিনগুলির মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। নতুন বছরের আগেই অনেক কিছু নির্ধারিত হতে পারে। আমরা আমাদের দিক থেকে সব করছি, কিন্তু সিদ্ধান্ত হবে কি না, তা নির্ভর করছে আমাদের অংশীদারদের উপর যারা ইউক্রেনকে সাহায্য করছে এবং যারা রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করছে, যাতে রুশরা তাদের আগ্রাসনের ফল অনুভব করে।”
এর মধ্যেই রবিবার এক ক্রেমলিন কর্মকর্তা জানান, সাময়িক যুদ্ধবিরতির বিরোধিতায় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার নেতৃত্বের মধ্যে মিল রয়েছে। তিনি ইঙ্গিত দেন, যুদ্ধ শেষ করতে হলে ইউক্রেনকে ডনবাস নিয়ে “সাহসী সিদ্ধান্ত” নিতে হবে। ক্রেমলিনের বিদেশনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ইউরি উশাকভ রয়টার্সকে বলেন, “ইউক্রেন ও ইউরোপের প্রস্তাবিত সাময়িক যুদ্ধবিরতি আসলে সংঘাত দীর্ঘায়িত করবে এ বিষয়ে রাশিয়া ও আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের দৃষ্টিভঙ্গি একই।”
উল্লেখযোগ্যভাবে, ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল পোস্টে জানান, জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকটি মার-আ-লাগোর প্রধান ডাইনিং রুমে অনুষ্ঠিত হবে এবং সেখানে গণমাধ্যমের উপস্থিতিও থাকবে।
প্রসঙ্গত, গত ফেব্রুয়ারিতে দুই দেশের মধ্যে সম্ভাব্য খনিজ চুক্তি নিয়ে ট্রাম্প ও জেলেনস্কির এক বৈঠক প্রকাশ্যে বিতর্কে রূপ নেয়। সেই সময় ট্রাম্প ও মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, জেলেনস্কিকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতি “অসম্মানজনক” আচরণের অভিযোগ করেছিলেন। সেই টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে এবারের বৈঠক ও শান্তি আলোচনার অগ্রগতি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
