আর কে দাস (প্রাক্তন বায়ুসেনা কর্তা): নিয়ন্ত্রণ হারিয়েই তেজস দুর্ঘটনা। ঘটনাটা ঘটল খুব কম উচ্চতায় যখন পাইলট কসরৎ দেখাচ্ছিলেন। যেটাকে বলা হয় 'নেগেটিভ জি টার্ন'। ব্যাপারটা হল এই দুর্ঘটনার পর অনেকেই অনেক কিছু বলছেন বা মতামত প্রকাশ করেছেন কিন্তু আসল সত্য তখনই বেরিয়ে আসবে যখন 'কোর্ট অফ এনকোয়ারি' শেষ হবে। তবে এই দুর্ঘটনায় একটা জিনিস আমার মনে হয়েছে পাইলট এক্ষেত্রে হয়ত 'জি-ফোর্স ব্ল্যাকআউট'-এর মুখোমুখি হয়েছিলেন। যেখানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির এক বিরাট আকর্ষণ সাময়িক জ্ঞান হারানো বা কত উঁচুতে আছি বা নিজের জায়গা বা গতি সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্তেই আসা যায় না। যার ফলে বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাত থেকে বেরিয়ে যায়। 

এক্ষেত্রে পাইলট উইং কমান্ডার নমন স্যালে বিমান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। শেষপর্যন্ত বিমান আছড়ে পড়ে মাটিতে এবং আগুন ধরে যায়। ঘটনাটা যখন ঘটে তার আগেই তেজস আকাশে একের পর এক ওলট পালট খেতে খেতে 'শো' দেখাচ্ছিল। যার জেরে পাইলট নেমে আসেন বেশ কিছুটা নিচে। ফলে ফের উপরে উঠে যাওয়ার জন্য মাটি থেকে তাঁর বিমানের উচ্চতাটা  অনেকটাই কমে গিয়েছিল। আসলে অল্প উচ্চতায় এই ধরনের কসরৎ খুবই কঠিন। কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেকগুলো বিষয়। নিজে একজন যুদ্ধ বিমানের চালক হিসেবে বলছি এই জায়গায় প্রচন্ড ঝুঁকি থাকে। পাইলটকে ভীষণ পরিমানে সতর্ক থাকতে হয়। খেয়াল রাখতে হয় মাটি থেকে তাঁর বিমানের দূরত্বটা। কারণ ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সময় এবং জায়গাটা খুবই কম। আরও একটি জিনিস হল এক্ষেত্রে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টান থাকে খুবই বেশি। ফলে সিদ্ধান্তটা ভগ্নাংশেরও অনেক কম সময়ের মধ্যে নিতে হয়। 

এই পরিস্থিতিতে শরীরের উপর একটা বিরাট পরিবর্তন হয়। পাইলট জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারেন, ক্লান্তিভাব এবং দৃষ্টিশক্তির একটা বিরাট সমস্যা তৈরি হতে পারে। এমনকী এই ধরনের পরিস্থিতিতে বিমানের যন্ত্রাংশে কখনও কখনও ত্রুটিও তৈরি হতে পারে। এর সঙ্গে আরও একটি বড় সমস্যার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সেটা হল পেশী এবং গাঁটে সমস্যা তৈরি হতে পারে। 

এটা তো গেল একটা দিক। যদি যান্ত্রিক ত্রুটি যেমন বিমানের ইঞ্জিনে সমস্যা বা অন্য কোনো যন্ত্রে ত্রুটি হলে স্বাভাবিকভাবেই নিরাপদে বিমান অবতরণ তো সম্ভব নয়! নিয়ম হল এই ধরনের 'শো'-এর জন্য বিমান চালনার অনুমতি খুবই কম দেওয়া হয়। দেওয়ার আগে খুব ভালো করে পাইলটের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হয়। কারণ এর জন্য প্রয়োজন হাড়ভাঙা পরিশ্রম।‌ যে পাইলট এই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন তিনি বহুবার এর আগে এই বিষয়টি নিয়ে অনুশীলন করেছেন। কারণ এই ধরনের কসরৎ ভীষণরকম চ্যালেঞ্জিং। যুদ্ধ বিমানের পাইলটের গায়ে যে 'স্যুট' পরা থাকে সেটা কিন্তু আদৌ কোনো সাধারণ জামাকাপড় নয়। এই পোশাক তাঁকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত রাখে। এটাকে বলা হয় 'অ্যান্টি জি-স্যুট'। দ্বিতীয়ত যুদ্ধ বিমানের পাইলটদের শারীরিকভাবেও ভীষণরকম সক্ষম হতে হয়। যাতে তাঁর শরীর এই ধকলটা সইতে পারে। ফলে অনেককিছু মিলিয়েই তৈরি হয় একজন যুদ্ধ বিমানের পাইলট। পরিশেষে এটুকু বলতে পারি নমন স্যালে একজন অত্যন্ত দক্ষ পাইলট ছিলেন। ফলে এই মুহূর্তে অনেকরকম গল্পগাঁথা তাঁর মৃত্যু ঘিরে চলতে থাকলেও আসল ঘটনা প্রকাশ পাবে 'কোর্ট অফ এনকোয়ারি' শেষ হওয়ার পরেই।