আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিশ্বের বহু অংশের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহটি উৎসব ও উদযাপনের মধ্যে দিয়ে কাটে। তবে শিখ সম্প্রদায়ে মানুষদের জন্য এই সময়টি স্মরণ, আত্মত্যাগ এবং গভীর আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনার সময়। ১৭০৪ সালের এই সময়ে গুরু গোবিন্দ সিং জির পুরো পরিবারের শহিদ হয়ে যায়। এটি শিখ ইতিহাসের অন্যতম বেদনাদায়ক অধ্যায়ের একটি। এই সম্প্রদায়ের মানুষ এই সময়টিকে শাহীদি হফতা বা শাহীদি জোড় মেল নামে পালন করেন।

নানাকশাহী পঞ্জিকার দশম মাস পৌষ মাসে, মোটামুটি ২০ থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি বছর এই সময়টি পালন করা হয় সাহস, বিশ্বাস এবং ন্যায় ও শিখ ধর্মের মাথা উঁচু রাখার জন্য করা আত্মত্যাগকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে।

শহীদি জোর মেল এর অর্থ ‘শহিদদের স্মরণ’। বিশ্বজুড়ে শিখরা পালন করে থাকেন গুরু গোবিন্দ সিং-এর চার সাহেবজাদা (চার পুত্র) এবং মাতা গুজরি জি, ও আরও শত শত শিখের আত্মবলিদানকে সম্মান জানানোর জন্য। যাঁরা ধর্ম, ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ১৭০৪ সালের ঘটনাবলী

শহীদি জোড় মেল-এ স্মরণ করা ঘটনাগুলির সূত্রপাত হয় ১৭০৪ সালের ডিসেম্বরে। মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের বাহিনী আনন্দপুর সাহেব অবরোধ করে এবং খালসা আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা করে।

প্রথম দিন: আনন্দপুর সাহেব থেকে প্রস্থান

কয়েক মাস অবরোধ ও কষ্টের পর, গুরু গোবিন্দ সিং জি মুঘল বাহিনীর নিরাপদ পথের মিথ্যা আশ্বাসের ভিত্তিতে আনন্দপুর সাহেব ত্যাগ করতে রাজি হন। তাদের কথায় বিশ্বাস করে তিনি দুর্গ ত্যাগ করেন, যে সিদ্ধান্তটি মর্মান্তিক হয়।

দ্বিতীয় দিন: সিরসা নদীতে বিচ্ছেদ

নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা হয়েছিল। তীব্র শীতের মধ্যে প্লাবিত সিরসা (সরসা) নদী পার হওয়ার সময় গুরু গোবিন্দ সিং জি এবং তার পরিবারের উপর আক্রমণ করা হয়। গুরু গোবিন্দ সিং জির সঙ্গে ছিলেন তাঁর বড় দুই পুত্র বাবা অজিত সিং জি এবং বাবা জুঝার সিং জি, এবং ৪০ জন শিখ যোদ্ধা। অন্যদিকে, ছিলেন মাতা গুজরি জি এবং ছোট দুই পুত্র, বাবা জোরাওয়ার সিং জি (৯) এবং বাবা ফতেহ সিং জি (৭)।

তৃতীয় দিন: বড় সাহেবজাদাদের আত্মবলিদান

এরপর চামকৌরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যেখানে মাত্র ৪০ জন শিখ লক্ষাধিক সৈন্যের মুখোমুখি হন। অতুলনীয় সাহসিকতা প্রদর্শন করে বাবা অজিত সিং জি (১৮) এবং বাবা জুঝার সিং জি (১৪) বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁদের আত্মত্যাগ খালসার আদর্শকে তুলে ধরেছিল, “সওয়া লাখ সে এক লড়াউঁ”, একজন শিখ এক লক্ষের সমান।

চতুর্থ দিন: চামকৌরে অবশিষ্ট শিখদের আত্মবলিদান

একে একে চামকৌরে অবশিষ্ট শিখরাও তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেন। তাঁদের সাহস এই বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করে যে, সংখ্যা বা বয়স নয়, বরং বিশ্বাসই প্রকৃত শক্তি নির্ধারণ করে।

পঞ্চম দিন: শেষকৃত্য এবং গুরু জির পলায়ন

যুদ্ধের পর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। পঞ্চ পেয়ারার পরামর্শে গুরু গোবিন্দ সিং জি চামকৌর ত্যাগ করেন যাতে শিখ ধর্ম এবং খালসার মিশন টিকে থাকতে পারে এবং অব্যাহত থাকে। 

৬-৮ দিন: বিশ্বাসঘাতকতা, গ্রেপ্তার এবং কারাবাস

এদিকে, মাতা গুজরি জি এবং ছোট সাহেবজাদারা আশ্রয় নিলেও তাঁদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয় এবং মুঘলদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তাঁদের সিরহিন্দে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে গভর্নর ওয়াজির খান তাঁদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করার চেষ্টা করেন। তাঁদের প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে খাবার, বিছানা বা গরম কাপড় ছাড়াই ঠান্ডা বুর্জ (শীতল দুর্গ)-এ বন্দি করে রাখা হয়েছিল। এই সময়ে, ভাই মতি রাম মেহরা এবং তাঁর পরিবার গোপনে তাঁদের দুধ সরবরাহ করার জন্য পরে শহিদ হন।

নবম দিন: ছোট সাহেবজাদাদের আত্মবলিদান

শিখ ধর্ম ত্যাগ করতে অস্বীকার করায় বাবা জোরাওয়ার সিং জি (৯) এবং বাবা ফতেহ সিং জিকে (৭) নির্মমভাবে জীবন্ত ইটের গাঁথুনিতে গেঁথে হত্যা করা হয়। এই খবর শুনে মাতা গুজরি জিও ঠান্ডা বুর্জেই মৃত্যুবরণ করেন।

দশম দিন: শেষকৃত্য সম্পন্ন

পরের দিন, মাতা গুজরি জি এবং ছোট সাহেবজাদাদের শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। এটি শিখ ইতিহাসের অন্যতম অন্ধকারাচ্ছন্ন অথচ সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ক অধ্যায়ের সমাপ্তি চিহ্নিত করে।