আজকাল ওয়েবডেস্ক: উত্তরপ্রদেশ সরকার সম্প্রতি আদালতে আবেদন করেছে ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গ্রেটার নয়ডার এক গ্রামে মহম্মদ আখলাককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা প্রত্যাহার করার জন্য। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের এই সিদ্ধান্ত আসলে সংঘ পরিবার যে অবস্থান শুরু থেকেই নিয়েছিল, তারই সরাসরি ধারাবাহিকতা—এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

২০১৫ সালের এই ঘটনা ছিল দেশে প্রথম দিকের সেইসব ভয়াবহ ঘটনার একটি, যেখানে গরুর মাংস রাখার সন্দেহে একজন মুসলিম নাগরিককে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। লেখক, শিল্পী, কবিদের মধ্যে শুরু হয়েছিল ‘অওয়ার্ড ওয়াপসি’ আন্দোলন—সরকারি পুরস্কার ফেরত দিয়ে তাঁরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু সংঘ পরিবারের পক্ষ থেকে দ্রুত অভিযুক্তদের প্রতি সমর্থনমূলক বক্তব্য আসতে শুরু করে।

তৎকালীন সংস্কৃতি মন্ত্রী মহেশ শর্মা, যার লোকসভা এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছিল, দাবি করেছিলেন—গোমাংস দেখলে “আমাদের আত্মা কেঁপে ওঠে”। তিনি গরু পাচারকারীদের দোষারোপ করে বলেন যে তাঁদের কর্মকাণ্ডে হিন্দুরা ক্ষুব্ধ হয়েছিল। এমনকি আখলাকের বাড়িতে থাকা তাঁর ১৭ বছর বয়সী মেয়ের প্রসঙ্গ টেনে শর্মা বলেন, “কেউ তাকে স্পর্শও করেনি”—যা দিয়ে তিনি অভিযুক্তদের চরিত্র সার্টিফিকেট দেওয়ার চেষ্টা করেন।

এরপরই হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনহরলাল খাট্টার মন্তব্য করেন—যদি মুসলিমরা গরুর মাংস খেতে চান, তবে তাঁদের ভারত ছেড়ে চলে যেতে হবে। আরএসএস-এর মুখপত্র পাঞ্চজন্য পরে একটি কভার স্টোরি ছাপে, যেখানে বেদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, গরু হত্যাকারীদের ‘প্রাণ নেওয়া’ই বিধান। তখনো তদন্তে নিশ্চিত হয়নি যে আখলাকের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া মাংস আদৌ গরুর ছিল কিনা। পরে পরীক্ষায় পরিষ্কার হয়—সেটি গরুর মাংস ছিল না। কিন্তু পাঞ্চজন্য ততক্ষণে তাকে ‘দোষী’ ঘোষণা করে দিয়েছিল।

কভার স্টোরিতে লেখা হয়েছিল—“তোমরা আখলাকের দ্বারা সংঘটিত গৌহত্যা দেখছ না… যদি ৮০% সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুভূতিকে সম্মান না দাও, তবে এমন ‘প্রতিক্রিয়া’ কীভাবে থামবে?” নিউটনের ‘অ্যাকশন-রিঅ্যাকশন’ তত্ত্ব টেনে এনে সহিংসতাকে স্বাভাবিক করা হয়েছিল।

এমন অবস্থায় পুলিশের মামলা চলা কার্যত অর্থহীন হয়ে পড়ে। প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের বড় অংশই নিহত আখলাককে অপরাধী দেখাতে এবং হত্যাকারীদের পক্ষ নেওয়ার কাজে ব্যস্ত ছিল। এর ফলে গোরক্ষকদের মনোবল বেড়ে যায় এবং পরবর্তী বছরগুলোতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য হিংসার ভিত্তি তৈরি হয়।

আখলাকের হত্যার পর দেশে লেখক সমাজের মধ্যে যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ দেখা দিয়েছিল, সেটিও ছিল নজিরবিহীন। ২০১৪ সালে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর মাত্র চোদ্দ মাসের মাথায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। প্রথমে হিন্দি লেখক উদয় প্রকাশ ২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দেন, কন্নড় লেখক এম.এম. কালাবুর্গির হত্যার প্রতিবাদে। কিন্তু আখলাকের লিঞ্চিং দেশজুড়ে প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে দেয়।

৬ অক্টোবর নায়নতার সহগাল তাঁর পুরস্কার ফেরত দেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আশোক বাজপেয়ীও একই পথে হাঁটেন। ৯ অক্টোবর শশী দেশে পান্ডে অকাদেমির সাধারণ পরিষদ থেকে ইস্তফা দেন। এর আগেই কয়েকজন কন্নড় ও উর্দু লেখক তাঁদের রাজ্য পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। পরের দিন সারাহ জোসেফ পুরস্কার ফেরান, কে. সচ্চিদানন্দন অকাদেমির বিভিন্ন কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন, আর কৃষ্ণা সোবতি তাঁর পুরস্কার ও ফেলোশিপ—দুটি-ই ফিরিয়ে দেন।

দেশের নানা প্রান্ত থেকে—কাশ্মীর, মণিপুর, কেরালা—অনেক লেখক ও শিল্পী প্রতিবাদে সামিল হন। তাঁদের অধিকাংশই আখলাকের হত্যাকাণ্ডকে দেশের সহিষ্ণুতা-বিরোধী পরিবেশের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেন।

ঠিক তখনই বিহার বিধানসভা নির্বাচন সামনে। বিজেপি শেষ পর্যন্ত সেই নির্বাচন হারে। লেখকদের প্রতিবাদকে মোদি সরকার তখন ‘স্পনসর্ড’ বলে প্রচার করে। প্রচার করা হয় যে, সবটাই বিহার নির্বাচনে প্রভাব ফেলার কৌশল। বামপন্থী লেখকদের পরিকল্পিত পদক্ষেপ বলেও অভিযোগ আনা হয়, যদিও তালিকায় থাকা বহু লেখক বরাবরই বামেদের সমালোচক ছিলেন।

আজ, এক দশক পর, উত্তরপ্রদেশ সরকারের মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত তেমন কোনও  আলোড়ন তুলতে পারেনি। যে ঘটনা তখন দেশজুড়ে ভয়াবহ আলোড়ন তুলেছিল, যে হত্যাকাণ্ড পরবর্তী বহু গণপিটুনির ভিত্তি তৈরি করেছিল—আজ তা বিজয়োল্লাসের খবরে চাপা পড়ে গেছে। প্রতিবাদী কণ্ঠও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। পাশ ফিরে কেউ কেউ বলছেন—এই ধরনের প্রতিবাদে কোনও  লাভই হয় না। তাঁরা এখনো শাসকদলের বিরোধিতায় অবিচল, কিন্তু প্রতিবাদের পথ ও পদ্ধতি নিয়ে তাঁদের মনে এসেছে গভীর সংশয়।

এটাই এই শাসনব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সাফল্য—প্রতিবাদের সবচেয়ে উঁচু স্বরগুলোকে ক্লান্ত করে দেওয়া, সাহসী মানুষদেরও নিজেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিধায় ফেলে দেওয়া। আখলাক হত্যার এক দশক পর, সরকারের প্রকৃত রিপোর্ট কার্ড হয়তো এখানেই লুকিয়ে আছে—ভয় ও অসহায়তার এই নীরবতায়।