আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিশ্বের সবুজ জ্বালানি রূপান্তরের কেন্দ্রে রয়েছে এক ক্ষুদ্র অথচ অপরিহার্য উপাদান—স্থায়ী চুম্বক। এটি কখনও ইভি লঞ্চ ইভেন্টে ক্যামেরার সামনে আসে না, কিংবা সমুদ্রতটের উইন্ড টারবাইনে দৃশ্যমানও নয়। কিন্তু এই ছোট্ট চুম্বক ছাড়া একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি কেবল লোহার কাঠামো, আর টারবাইনের ব্লেড হয়ে যায় নিছক এক ভাস্কর্য।


এই চুম্বকগুলি মূলত নিওডিমিয়াম, লোহা ও বোরন দিয়ে তৈরি। এগুলিই পরিষ্কার জ্বালানি প্রযুক্তির প্রাণশক্তি যেখান থেকে উৎপন্ন হয় গতি। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা অনুমান করছে, ২০৩০ সালের মধ্যে নিওডিমিয়াম চুম্বকের বিশ্বে চাহিদা দ্বিগুণ হবে, কারণ বৈদ্যুতিক যানবাহন ও উইন্ড টারবাইন উৎপাদন অভূতপূর্ব হারে বাড়ছে।


একটি ইভি মোটরের কার্যক্ষমতার প্রায় ৩০% নির্ভর করে চুম্বকের শক্তির উপর। অন্যদিকে, একটি অফশোর উইন্ড টারবাইনের কেন্দ্রে থাকে প্রায় দুই টন চুম্বক। এত ছোট উপাদান কখনও এত বড় প্রভাব ফেলে নি।


ভারতও এই দৌড়ে নেমেছে বিশাল উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে—লক্ষ লক্ষ ইভি, দ্রুত বর্ধনশীল উইন্ড শক্তি, উন্নত ইলেকট্রনিকস উৎপাদন, আর প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরতা। কিন্তু এই শক্তির নিয়ন্ত্রণ এক দেশেই—চীনে।


বিশ্লেষকরা বলছেন, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন চুম্বক উৎপাদনে চীনের দখল ৮০-৯০%, আর হেভি রেয়ার আর্থ উপাদানে ৯৫%—যেগুলি চুম্বককে অতিরিক্ত গরম হওয়া থেকে রক্ষা করে, বিশেষত ভারতের উষ্ণ আবহাওয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত বছর চীন রেয়ার আর্থ রপ্তানিতে নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করে—শুধু কাঁচামাল নয়, চুম্বক তৈরির যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রেও। এতে ভারতের আমদানি প্রক্রিয়া জটিল ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত চীন থেকে ৫৩,০০০ টনেরও বেশি রেয়ার আর্থ চুম্বক আমদানি করেছে, যা মোট আমদানির ৯০%-এর বেশি।


শুধু ইভি উৎপাদনের জন্যই ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের বছরে ৮,০০০ থেকে ১০,০০০ টন চুম্বক লাগবে—উইন্ড শক্তির জন্য লাগবে আরও হাজার হাজার টন। এই বাড়তি চাহিদা ও স্থির সরবরাহের ফাঁক এখন নীতি-নির্ধারণে প্রভাব ফেলছে।


সরকার এখন দেশীয় চুম্বক উৎপাদনে সমর্থন তিনগুণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। প্যাকেজ হবে প্রায় ৭,০০০ কোটি টাকার বেশি, সাত বছরের জন্য। এটি সরাসরি ভর্তুকি নয়, বরং কৌশলগত সুরক্ষা। ভারতের শক্তি রয়েছে মাটিতেই—বিশ্বের প্রায় ৬% রেয়ার আর্থ মজুত ভারতেই, মূলত ওড়িশা থেকে অন্ধ্র উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায়।


আইআরইএল, একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, বহু বছর ধরে এই খনিজ প্রক্রিয়াজাত করছে। তবে শেষ ধাপ—অর্থাৎ সূক্ষ্ম কৌশল ও সিন্টারিং প্রক্রিয়া, যা গুঁড়ো খনিজকে শক্তিশালী চুম্বকে রূপ দেয়—তা এতদিন বিদেশের উপর নির্ভর করত। এখন সেই মূল্য সংযোজনের ক্ষমতা দেশে ফিরছে।

 আইআরইএল ইতিমধ্যে বিশাখাপত্তনমে একটি রেয়ার আর্থ পার্মানেন্ট ম্যাগনেট কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করেছে, যা প্রতিরক্ষা ও ইভি খাতকে চাহিদা পূরণে সহায়তা করবে। এদিকে ন্যাশনাল ক্রিটিকাল মিনারেল মিশন দেশীয় খনি, পুনর্ব্যবহার ও বিদেশি নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ নিচ্ছে।


চীন ২০১০ সালে রেয়ার আর্থ রপ্তানি সীমিত করলে জাপান ভয়াবহ সরবরাহ সংকটে পড়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আজ তারা ভারতের স্বাভাবিক মিত্র। টয়োটসু রেয়ার আর্থস ইন্ডিয়া ইতিমধ্যেই দেশে প্রক্রিয়াকরণ করছে, আর প্রোটেরিয়াল ভারতীয় উৎপাদন নিয়ে গুরুত্ব সহকারে ভাবছে।


যদি এই প্রচেষ্টা সফল হয়, তবে এর প্রভাব পৌঁছাবে প্রতিদিনের জীবনে। ইলেকট্রিক টু-হুইলার থেকে শুরু করে উইন্ড টারবাইন—সব ক্ষেত্রেই ভারতের উপর নির্ভরতা কমবে। দেশীয় উৎপাদন বাড়লে প্রকৌশলভিত্তিক কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি পাবে।


সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ভারত এখন পুনর্ব্যবহারের দিকেও নজর দিচ্ছে—ইউরোপের মডেলে যেখানে পুরনো ইভি মোটর থেকে ৫০% পর্যন্ত চুম্বক ধাতু পুনরুদ্ধার সম্ভব। চুম্বক ছোট হলেও এর প্রভাব বিশাল। এই ক্ষুদ্র উপাদানই নির্ধারণ করছে একটি দেশের শিল্প-স্বাধীনতা ও কৌশলগত শক্তি। ভারত এখন বুঝতে পারছে—যে দেশ চুম্বক নিয়ন্ত্রণ করে, সেই দেশই ভবিষ্যতের গতি নির্ধারণ করে।