আজকাল ওয়েবডেস্ক: লোকসভার বিরোধী দলনেতা ও কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী আবারও সাম্প্রতিক হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তুলেছেন। গত বছরের নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে রাহুল দাবি করেছেন, হরিয়ানায় প্রতি আটটি ভোটের মধ্যে একটি নাকি ভুয়ো। তিনি একটি ব্রাজিলিয়ান মডেলের ছবি দেখিয়ে অভিযোগ করেন, সেই মহিলার ছবি ব্যবহার করে ১০টি ভিন্ন বুথে ২২টি ভোট পড়েছে। রাহুলের দাবি, মোট প্রায় ২৫ লক্ষ ভুয়ো ভোট পড়েছিল সেই নির্বাচনে।

রাহুল গান্ধী নির্বাচনী নথি দেখিয়ে দাবি করেন, ওই ব্রাজিলিয়ান মডেলের ছবি ২২ জন আলাদা বয়সের নারীর ভোটার কার্ডে ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁর আরও অভিযোগ, হাজার হাজার বিজেপি নেতা-কর্মীকে উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানা — দুই রাজ্যেই ভোটার হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এমনকি একাধিক ভোটারকে একই ঠিকানায় নথিভুক্ত করা হয়েছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।

তবে ভারতের নির্বাচন কমিশন (ECI) রাহুলের নতুন অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে খারিজ করেছে। কমিশনের মতে, ভোটার তালিকা ও ভোটার আইডি যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কোনও ধরনের জালিয়াতির সুযোগ নেই। তবু রাহুলের বক্তব্য ঘিরে দেশজুড়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে — বিশেষ করে বুথ লেভেল অফিসার (BLO) বা ভোটার তালিকা সংশোধনের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের ভূমিকা নিয়ে।

বুথ লেভেল অফিসাররা কী করেন?

ভোটার তালিকার সঠিকতা বজায় রাখার দায়িত্বে রয়েছেন BLOরা। রাজস্থানের বিদ্যাধর নগর বিধানসভা কেন্দ্রের এক BLO জানিয়েছেন, তাঁদের মূল দায়িত্ব হল নতুন ভোটারদের তথ্য যাচাই করা, পুরনো তথ্য যাচাই করা এবং প্রয়োজনে মৃত বা স্থানান্তরিত ভোটারদের নাম মুছে ফেলা। তাঁরা সাধারণ নাগরিক ও নির্বাচন কমিশনের মধ্যে এক প্রকার সেতুবন্ধনের কাজ করেন। কখনও বুথে ক্যাম্প করে, কখনও বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের তথ্য যাচাই করেন। যাচাই সম্পূর্ণ হলে তাঁরা ভোটার আইডি কার্ডও পৌঁছে দেন ভোটারদের হাতে।

তবে BLO ও BLA (Booth Level Agent)-এর মধ্যে পার্থক্য বোঝা জরুরি। BLO হলেন সরকারি নিযুক্ত কর্মচারী, অন্যদিকে BLA হলেন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, যিনি BLO-কে সহায়তা করেন ভোটার তালিকা যাচাইয়ের সময়।

কীভাবে BLO নিয়োগ হয় এবং তাঁদের কাজ কীভাবে চলে?

জেলা নির্বাচন দপ্তর  থেকে কোনও সরকারি কর্মচারীকে BLO হিসেবে নিয়োগ করা হয়। প্রতিটি BLO-কে নির্দিষ্ট কিছু বুথের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার তালিকা হালনাগাদ রাখার নির্দেশ থাকে। তাঁদের কাজ হল —

নতুন বাসিন্দাদের নাম যুক্ত করা,

যাঁরা এলাকা ছেড়েছেন তাঁদের নাম বাদ দেওয়া,

মৃত ভোটারদের নাম সরিয়ে দেওয়া, এবং

যাঁরা সদ্য ১৮ বছরে পা দিয়েছেন তাঁদের ভোটার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা।


এই কাজটি বছরে একবার নিয়মিতভাবে করা হয় — অনলাইন ও অফলাইন দুইভাবেই।

অনলাইন ও অফলাইন প্রক্রিয়ার জটিলতা

অনলাইন প্রক্রিয়ায় BLOরা একটি নির্দিষ্ট মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নোটিফিকেশন পান। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে তাঁদের আবেদন যাচাই করতে হয়। সময়মতো যাচাই না করলে সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে (auto-verify) আবেদনটি অনুমোদন করে দেয়, যার ফলে ভুল ছবি বা তথ্য আপলোড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

অফলাইন প্রক্রিয়ায় BLOরা নতুন ভোটারের জন্য ফর্ম-৬ পূরণ করান এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্র জেলা নির্বাচন দপ্তরে জমা দেন। BLOদের বক্তব্য, তাঁরা ছবি যাচাইয়ের কাজ করেন, কিন্তু প্রযুক্তিগত ত্রুটি, অ্যাপের সমস্যা বা সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক সময় ভুল ঘটে যেতে পারে।

পারিশ্রমিক ও বাস্তব সমস্যা

রাজস্থান ও হরিয়ানার BLOরা জানিয়েছেন, বর্তমানে তাঁদের বার্ষিক পারিশ্রমিক মাত্র ৬,০০০ টাকা। তবে একে ১২,০০০ টাকায় বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, দায়িত্বের তুলনায় এই পারিশ্রমিক অত্যন্ত অপ্রতুল, ফলে কাজের প্রতি মনোযোগ কমে যাচ্ছে।

বিশেষ নিবিড় সংশোধন অভিযান (SIR) ও BLOদের ভূমিকা

বর্তমানে ভোটার তালিকা বিশুদ্ধ করার জন্য যে Special Intensive Revision (SIR) অভিযান চলছে, তাতেও BLOদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাঁদের দায়িত্ব হল Unique Enumeration Form বিতরণ করা এবং ভোটারদের ২০০৩ সালের তালিকার সঙ্গে সংযুক্ত করা। যদি কোনও ভোটার বা তাঁর বাবা-মায়ের নাম সেই পুরনো তালিকায় থাকে, তাহলে অতিরিক্ত নথিপত্র জমা দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। BLOদের নিশ্চিত করতে হয়, সেই সংযোগ সঠিকভাবে স্থাপিত হয়েছে কিনা, খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের আগে।

প্রযুক্তিগত ত্রুটি নাকি মানবিক ভুল?

BLOদের একাংশের বক্তব্য, ছবি ভুল হওয়ার ঘটনা ঘটে মূলত তখনই, যখন তাঁরা অ্যাপের নোটিফিকেশন সময়মতো খোলেন না, আর আবেদনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুমোদিত হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই সার্ভারের ত্রুটি, ধীর ইন্টারনেট সংযোগ বা অতিরিক্ত কাজের চাপের জন্যও ভুল ঘটে।

রাহুল গান্ধীর অভিযোগ সত্যি হোক বা না হোক, তাঁর বক্তব্যে যে প্রশ্নগুলো সামনে এসেছে — ভোটার তালিকার নির্ভরযোগ্যতা, প্রযুক্তিগত ত্রুটি, এবং BLOদের কাঠামোগত সমস্যা — তা নিয়ে আলোচনা এখন জরুরি। নির্বাচন কমিশন যদিও ভোট জালিয়াতির অভিযোগ অস্বীকার করেছে, তবুও এই বিতর্ক দেখিয়ে দিচ্ছে, ভারতের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তৃণমূল স্তরের কর্মীদের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং তাঁদের কাজের প্রতি নজরদারি ও সহায়তা কতটা প্রয়োজন।