আজকাল ওয়েবডেস্ক: ২১ নভেম্বর কেন্দ্রীয় সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করে চারটি শ্রম কোড কার্যকর করেছে কোড অন ওয়েজেস, ২০১৯; অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশনস কোড (OSH), ২০২০; সোশ্যাল সিকিউরিটি কোড, ২০২০; এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস (IR) কোড, ২০২০। ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সংসদে পাশ হওয়া এই চারটি কোডকে সরকার ‘ব্রিটিশ আমলের শ্রম আইনের অবসান’ এবং ‘শ্রম সংস্কার’ হিসেবে তুলে ধরলেও, শ্রমিক সংগঠনগুলির মতে এটি কার্যত শ্রমিক অধিকারের উপর একটি সরাসরি আক্রমণ।

কর্পোরেট জগতের তরফে এই শ্রম কোডগুলিকে স্বাগত জানানোই স্পষ্ট করে দেয়, এই সংস্কার আদতে কাদের স্বার্থ রক্ষা করছে। ট্রেড ইউনিয়নগুলির দাবি, নতুন শ্রম কোড কার্যকর হলে শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার, কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা, ন্যায্য মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা মারাত্মকভাবে খর্ব হবে। সেই কারণেই আগামী দিনে দেশজুড়ে আন্দোলন তীব্রতর হওয়ার ইঙ্গিত মিলছে।

এই শ্রম কোডগুলির সংসদীয় অনুমোদন প্রক্রিয়াকেই প্রথম থেকেই ‘অগণতান্ত্রিক’ বলে দাবি করে আসছে শ্রমিক সংগঠনগুলি। ২০২০ সালে কৃষি আইন পাশ ঘিরে সংসদে তীব্র অস্থিরতার মধ্যেই কোনও আলোচনা ছাড়াই চারটির মধ্যে তিনটি বিল পাশ করানো হয়। এর প্রতিবাদে ট্রেড ইউনিয়নগুলি একাধিকবার দেশজুড়ে সাধারণ ধর্মঘট ডাকে। তবু সমস্ত আপত্তি উপেক্ষা করেই সরকার কোডগুলি কার্যকর করার পথে এগিয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই শ্রম কোডগুলির মূল বৈশিষ্ট্য হল শ্রম আইন থেকে বিপুল সংখ্যক শ্রমিককে চাকরির নিরাপত্তা থেকে কার্যত বাইরে ঠেলে দেওয়া। অধিকাংশ শ্রম আইনই নির্দিষ্ট কর্মীসংখ্যার বেশি কর্মরত থাকলেই প্রযোজ্য হয়। নতুন কোডগুলিতে সেই সীমা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হয়েছে, ফলে বহু ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা আইনি সুরক্ষা হারাবেন।

উদাহরণস্বরূপ, ফ্যাক্টরিজ অ্যাক্ট, ১৯৪৮ অনুযায়ী বিদ্যুৎচালিত কারখানায় ১০ জন এবং বিদ্যুৎহীন কারখানায় ২০ জন কর্মী থাকলেই আইনটি প্রযোজ্য হত। নতুন কোডে সেই সীমা বাড়িয়ে যথাক্রমে ২০ এবং ৪০ করা হয়েছে। পরিসংখ্যান ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন মন্ত্রকের প্রকাশিত ২০২২–২৩ সালের বার্ষিক শিল্প সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশের ৪৩.২ শতাংশ কারখানায় ২০ জনের কম কর্মী কাজ করেন। এই বিপুল সংখ্যক শ্রমিক এখন আইনগত সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হবেন।

শ্রমিক ও মালিকপক্ষের সম্পর্ক স্বভাবতই অসম- এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল এমপ্লয়মেন্ট (স্ট্যান্ডিং অর্ডার্স) অ্যাক্ট, ১৯৪৬ প্রণীত হয়েছিল। এই আইনে ১০০ বা তার বেশি কর্মী থাকা প্রতিষ্ঠানে চাকরির শর্ত নির্ধারণ বাধ্যতামূলক ছিল এবং তা সরকারি অনুমোদনের আওতায় আসত। নতুন IR কোডে সেই সীমা বাড়িয়ে ৩০০ করা হয়েছে। এর ফলে ৩০০ জনের কম কর্মী থাকা অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই চাকরির শর্ত সম্পূর্ণভাবে মালিকের ইচ্ছাধীন হয়ে গেল।

একই সঙ্গে ছাঁটাই, লে-অফ ও কারখানা বন্ধের ক্ষেত্রেও নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা হয়েছে। এতদিন ১০০ জনের বেশি কর্মী থাকলে সরকার অনুমোদন ছাড়া ছাঁটাই বা কারখানা বন্ধ করা যেত না। এখন সেই সীমাও বেড়ে ৩০০। অর্থাৎ, ছোট ও মাঝারি শিল্পে কর্মরত লক্ষ লক্ষ শ্রমিক মুহূর্তের মধ্যে কাজ হারানোর ঝুঁকিতে পড়বেন।

চুক্তিভিত্তিক শ্রম ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। কন্ট্র্যাক্ট লেবার (রেগুলেশন অ্যান্ড অ্যাবোলিশন) অ্যাক্ট, ১৯৭০ অনুযায়ী ২০ জন বা তার বেশি শ্রমিক থাকলে আইনটি প্রযোজ্য ছিল। OSH কোডে সেই সীমা বাড়িয়ে ৫০ করা হয়েছে। ফলে চুক্তিভিত্তিক শ্রমের বিস্তার আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চুক্তিভিত্তিক শ্রম ব্যবস্থা ভারতে গভীরভাবে জাত ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। সাফাই, পরিচ্ছন্নতা, বাগান পরিচর্যা, ক্যান্টিন, নিরাপত্তা, লোডিং-আনলোডিং এই ধরনের কাজ মূলত দলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। অথচ OSH কোডে এই কাজগুলিকেই ‘কোর অ্যাক্টিভিটি’র বাইরে রাখা হয়েছে। ফলে এই শোষণমূলক ব্যবস্থাকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বলেই অভিযোগ।

ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। IR কোড অনুযায়ী রেজিস্ট্রার কোনও ‘তথ্যের ভিত্তিতে’ ট্রেড ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করতে পারেন। এর ফলে সংগঠনগুলির উপর প্রশাসনিক চাপ বাড়বে এবং আন্দোলন দমন সহজ হবে বলে আশঙ্কা।

ধর্মঘটের অধিকারও কার্যত নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি শ্রমিক সংগঠনগুলির। আগে কেবল ‘পাবলিক ইউটিলিটি সার্ভিস’-এ ধর্মঘটের নোটিশ  বাধ্যতামূলক ছিল। এখন সব ক্ষেত্রেই ১৪ দিনের নোটিশ  প্রয়োজন, আর সেই নোটিশ  দিলেই মীমাংসা প্রক্রিয়া শুরু হয় যেই  সময় ধর্মঘট নিষিদ্ধ। পাশাপাশি বেড়েছে জরিমানার অঙ্কও।

মহিলা  শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও এই কোডগুলির প্রভাব গুরুতর। সমান কাজের জন্য সমান মজুরির সাংবিধানিক নীতিকে দুর্বল করা হয়েছে বলে অভিযোগ। মজুরির সংজ্ঞা বদলে দিয়ে নানা ভাতা বাদ দেওয়ায় পরোক্ষ বৈষম্যের পথ খুলে যাচ্ছে। মাতৃত্বকালীন ভাতাও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মহিলাদের  নাইট শিফটে কাজের অনুমতি দেওয়া হলেও, শ্রমিক সংগঠনগুলির মতে, এটি ‘স্বাধীনতা’ নয়, বরং নিরাপত্তাহীন পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করার আইনি রাস্তা।

১৯৯০ সালে সুপ্রিম কোর্ট চুক্তিভিত্তিক শ্রম ব্যবস্থাকে ‘বন্ডেড লেবারের উন্নত সংস্করণ’ বলে উল্লেখ করেছিল। শ্রম কোড কার্যকরের মাধ্যমে সেই আশঙ্কাই বাস্তব রূপ নিচ্ছে বলে মনে করছে শ্রমিক মহল।