আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভারতের উপকূলীয় শহরগুলোর ওপর ক্রমবর্ধমান বন্যার ঝুঁকি ঘনিয়ে আসছে, যার প্রধান কারণ দ্রুত উষ্ণ হওয়া  বিশ্ব এবং এখন প্রায় নিয়মিত হয়ে যাওয়া চরম আবহাওয়ার ঘটনা। কিছু শহর তুলনামূলকভাবে বেশি বিপদের মুখে থাকলেও দেশের বহু উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে মানুষের জীবন, জীবিকা, নগর পরিকাঠামো ও ক্রিটিক্যাল পরিষেবা একইভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ছে। গবেষণা বলছে, আন্তর্জাতিক  সমুদ্রস্তর ১৮০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি প্রতি বছর গড়ে ৩.২২ মিলিমিটার হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনুমান অনুযায়ী, চলতি শতাব্দীর শেষে সমুদ্রস্তর সর্বোচ্চ ১ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে।

তবে এই আন্তর্জাতিক  গড় বৃদ্ধিই পুরো সত্য নয়। স্থানীয় সমুদ্রস্তর অনেকটাই নির্ভর করে সাগরের স্রোত, আঞ্চলিক গতিবিধি, এবং ভূমিধস বা ভূমিক্ষয়ের মতো প্রাকৃতিক ঘটনার ওপর। এ কারণে বিজ্ঞানীরা ‘রিলেটিভ মিন সি লেভেল’ বা আরএমএসএল—অর্থাৎ স্থানীয় সমুদ্রস্তর পরিবর্তনের হার—একটি বিশেষ পরিমাপক হিসেবে ব্যবহার করেন।

২০২৫ সালের জুলাইয়ে সরকারি সংস্থা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সেন্টার ফর ওশান ইনফরমেশন সার্ভিসেস (INCOIS) একটি গবেষণায় দেখিয়েছে যে ১৯৯৫ থেকে ২০১৪ সালের বেসলাইন সময়ের তুলনায় ২১০০ সালের মধ্যে ভারতের উপকূলীয় শহরগুলোয় আরএমএসএল বেড়ে যাবে বিশাখাপত্তনমে ৬২ সেমি এবং গুজরাটের ভাভনগরে ৮৭ সেমি পর্যন্ত। আন্তর্জাতিক  উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রস্তর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়, জোয়ারভাটা, অতিবৃষ্টি—সব মিলিয়ে উপকূলীয় শহরগুলোতে ‘এক্সট্রিম সি লেভেল’ বা চরম সমুদ্রস্তর পরিস্থিতি তৈরি হবে, যার উচ্চতা কয়েক মিটার পর্যন্ত হতে পারে। গবেষণা বলছে, মুম্বই, কলকাতা ও চেন্নাইয়ের মতো মেট্রোপলিটন শহরগুলো ভবিষ্যতে আরও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আইএনকোয়েসের হিসাব অনুযায়ী, নির্গমন কম নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বিশাখাপত্তনমে আরএমএসএল বাড়বে ৪০ থেকে ৬২ সেমি পর্যন্ত, আর ভাভনগরে এই পরিমাণ হবে ৬৩ থেকে ৮৭ সেমি পর্যন্ত। স্থানীয় জোয়ার ও ঝড়ো ঢেউয়ের কারণে এখানে চরম সমুদ্রস্তর বৃদ্ধি দাঁড়াতে পারে ৮৭ থেকে ১১২ সেমি পর্যন্ত। এই তথ্য উপকূলীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় জরুরি প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তাকে আরো প্রকট করে। এ বছরের আগস্টে অতিবৃষ্টিতে বিশাখাপত্তনমে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, আর স্থানীয় প্রশাসন ওয়েবসাইটে উপকূল ক্ষয়কে ‘ক্রনিক ইভেন্ট’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

তুলনা করতে গেলে, ১ মিলিমিটার মানে একটি বালুকণা, ১ সেন্টিমিটার একটি পেপার ক্লিপের সমান, ৩০ সেন্টিমিটার একটি সাধারণ স্কেলের দৈর্ঘ্য, ৬০ সেন্টিমিটার একটি স্যুটকেসের উচ্চতা, ৯০ সেন্টিমিটার একটি ডাইনিং টেবিলের মান উচ্চতা এবং ১২০ সেন্টিমিটার একটি সাত বছরের শিশুর উচ্চতার কাছাকাছি। এসব তুলনা থেকেই বোঝা যায়, আগামী দশকগুলোয় ভারতের উপকূলে যে জলস্তর বৃদ্ধি হবে, তার ফল কতটা ভয়াবহ হতে পারে।

আন্তর্জাতিক  প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট দ্বীপ দেশ টুভালু গত ৩০ বছরে সমুদ্রস্তর বাড়তে দেখেছে ১৪ সেন্টিমিটার, এবং আগামী ৩০ বছরে আরও ১৯ সেন্টিমিটার বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, এসব দ্বীপ দেশ মারাত্মকভাবে ডুবে যাওয়ার হুমকির মুখে রয়েছে—যে পরিস্থিতির সঙ্গে ভারতের উপকূলীয় শহরগুলোর ভবিষ্যৎ ঝুঁকিও অস্বাভাবিকভাবে মিল রয়েছে।

ঐতিহাসিকভাবে উত্তর ভারত মহাসাগর ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকা, এবং ভারতীয় উপমহাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো কয়েক মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারের ধাক্কায় নিয়মিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আইএনকোয়েসের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের উপকূলের বড় অংশ সমুদ্রস্তর থেকে মাত্র ৫ থেকে ১০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত, যা ভবিষ্যতের চরম সমুদ্রস্তর পরিস্থিতিতে আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। মিনিকয় ও পোর্ট ব্লেয়ারের মতো দ্বীপ অঞ্চলগুলোতে উচ্চ নির্গমন পরিস্থিতিতে সমুদ্রস্তর আরও দ্রুত বাড়বে বলে সতর্ক করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

নতুন আরেকটি গবেষণাপত্র, যা ভারত ও ইউএই–র গবেষকদের সহযোগিতায় আগস্টে প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে ২০৩০ থেকে ২১০০ সালের মধ্যে মুম্বই, কলকাতা ও চেন্নাই ভয়াবহ বন্যার ঝুঁকিতে থাকবে। সব নির্গমন পরিস্থিতিতেই মুম্বই সর্বাধিক ঝুঁকিতে রয়েছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, শহরের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে উপকূল ও নদী তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক এলাকা জুড়ে বন্যার বিস্তার ঘটবে। মুম্বইয়ের দক্ষিণাংশে রয়েছে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ভবন ও বিধানসভা। সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা যায়, শহরের বন্যাপ্রবণ ওয়ার্ডের সংখ্যা ১১ থেকে বেড়ে ১৩-তে দাঁড়িয়েছে, যা শহরের মোট জনসংখ্যার ৬১ শতাংশের আবাসস্থল। এই বর্ষায়ও শহরের একাধিক এলাকায় জলাবদ্ধতা ও বন্যা দেখা গেছে।

কলকাতার ছবিও খুব আলাদা নয়। হুগলি নদী ও বঙ্গোপসাগরের সন্নিকটে অবস্থিত হওয়ায় শহরটি নদী তীরবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। কম নির্গমন পরিস্থিতিতেও কিছুটা ঝুঁকি কমলেও নদী তীরবর্তী ও উপকূলীয় অঞ্চলে বিপদ রয়ে যায়। চেন্নাইয়ের ক্ষেত্রেও উচ্চ নির্গমন পরিস্থিতিতে শহরের উপকূলীয় পরিকাঠামো ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় তীব্র ঝুঁকি তৈরি হবে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।

বিশাখাপত্তনমের মতো শহরেও সমুদ্রস্তর বৃদ্ধিজনিত বন্যা ছড়িয়ে পড়বে শহরের অভ্যন্তরে। মাঝারি নির্গমন পরিস্থিতিতে তুলনামূলক কম হলেও উপকূলীয় এলাকার উল্লেখযোগ্য অংশ জলমগ্ন হবে। গবেষণা বলছে, মুম্বই, কলকাতা ও চেন্নাইয়ের ভৌগোলিক অবস্থানই তাদের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে, কারণ এসব এলাকায় সমুদ্রস্তর আপেক্ষিকভাবে বেশি এবং নির্গমন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকিও বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে উপকূলীয় ক্ষয়, নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস ও আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি আরও তীব্র হবে।

গবেষকরা বলছেন, মুম্বই ও কলকাতায় বন্যার ঝুঁকি ঠেকাতে অবিলম্বে জলরোধী ব্যারিয়ার, সিওয়াল এবং ঝড়ো ঢেউ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নির্মাণ জরুরি। পাশাপাশি দরকার দীর্ঘমেয়াদি শহরভিত্তিক অভিযোজন কৌশল, বন্দর অঞ্চলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, এবং নগর পরিকল্পনায় জলনিষ্কাশন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ। মাঝারি ঝুঁকির শহর যেমন কোচি ও মঙ্গালুরুতে প্রাকৃতিক বন্যা-প্রতিরোধী বাঁধ ও আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা জোরদার করার সুপারিশ করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় সরকার উপকূল রক্ষায় কিছু উদ্যোগ নিয়েছে—যেমন উপকূল ক্ষয় মোকাবিলায় তথ্যভিত্তিক ‘কোস্টাল ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম’ বা সিএমআইএস তৈরি করা, এবং ন্যাশনাল সেন্টার ফর কোস্টাল রিসার্চ (এনসিসিআর)–এর মাধ্যমে ভারতের উপকূলরেখার পরিবর্তন মানচিত্রায়ন। ২০২২ সালে এনসিসিআর ভারতীয় উপকূলরেখাকে ক্ষয়প্রবণ, সঞ্চয়প্রবণ ও স্থিতিশীল—এই তিন ভাগে শ্রেণিবদ্ধ করে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।

তবে উপকূলীয় পরিকাঠামো, পানীয় জলের উৎস, কৃষিজমি এবং মানুষের জীবিকা রক্ষার দায়িত্ব মূলত রাজ্য সরকারের। উদাহরণ হিসেবে মুম্বইয়ের কথা বলা যায়, যেখানে ২০২২ সালের মুম্বই জলবায়ু কর্মপরিকল্পনায় (MCAP) বন্যা মোকাবিলার পরিকাঠামো, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং জলাধার শক্তিশালী করার  কথা উল্লেখ রয়েছে।

আইআইটি বোম্বের অধ্যাপক ও আইপিসিসি–র লেখক সুবিমল ঘোষ বলেন, “প্রযুক্তি রয়েছে, সমস্যা বাস্তবায়নে।” তিনি জানান, বড় শহরগুলোর প্রয়োজন আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা, জলনিকাশের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ বা নতুনভাবে নকশা, সক্ষমতা বাড়ানো এবং নির্ভরযোগ্য বন্যা পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা। প্রতিটি শহরের উচিত বন্যা-অঞ্চল মানচিত্র ও নিজস্ব ‘আরবান ফ্লাড মডেল’ তৈরি করা, যেখানে বিভিন্ন ‘হোয়াট-ইফ’ পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হবে।

তাঁর মতে, দীর্ঘমেয়াদি সমুদ্রস্তর বৃদ্ধির পূর্বাভাসে এখনও কিছু অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে, যা গবেষণাপত্রগুলোতেও উল্লেখ আছে। কিন্তু ঝুঁকির মাত্রা যতই অনিশ্চিত হোক, ভারতের উপকূলীয় শহরগুলোর জন্য স্পষ্ট বার্তা হলো—সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি আর ভবিষ্যতের সমস্যা নয়, এটি এখনই নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। তাই সময়মতো উদ্যোগ না নিলে আগামী কয়েক দশকে এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।