আজকাল ওয়েবডেস্ক: কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী ভূপেন্দর যাদব গত এক সপ্তাহে একাধিকবার দাবি করেছেন, “অরাবল্লি সম্পূর্ণ নিরাপদ”, “কোনও নিয়ম শিথিল করা হয়নি”, এবং “অরাবল্লি সংরক্ষণই প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার”। সুপ্রিম কোর্টে অরাবল্লি পাহাড়ের নতুন সংজ্ঞা গৃহীত হওয়ার পর দেশজুড়ে যে তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তার প্রেক্ষিতেই এই ধারাবাহিক ব্যাখ্যা ও সরকারি বার্তা বলে দ্যা ওয়্যার-এর এক প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে।
২০ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের প্রস্তাবিত একটি ‘ইউনিফর্ম ডেফিনিশন’ গ্রহণ করে। সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী, কোনও ভূমিকে অরাবল্লির অংশ হিসেবে গণ্য করা হবে কেবল তখনই, যদি তা স্থানীয় মাটি থেকে উচ্চতার তুলনায় অন্তত ১০০ মিটার উঁচু হয়। দুটি পাহাড়ের মধ্যে দূরত্ব ৫০০ মিটারের মধ্যে থাকলে মাঝের অংশটিও অরাবল্লির অন্তর্ভুক্ত হবে। এই সংজ্ঞা বিশেষভাবে খনন সংক্রান্ত মামলার প্রেক্ষিতে সুপারিশ করেছিল সুপ্রিম কোর্ট গঠিত একটি কমিটি।
এই কমিটিতে শুধুমাত্র কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের আমলারা ছিলেন। কোনও স্বাধীন পরিবেশবিদ, ভূতত্ত্ববিদ, সমাজবিজ্ঞানী বা বন-বাস্তুতন্ত্র বিশেষজ্ঞকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এই বিষয়টি নিয়েই প্রথম থেকেই আপত্তি তুলেছেন পরিবেশ নীতি গবেষকেরা। তাঁদের মতে, আমলাদের তৈরি এই সংজ্ঞা বৈজ্ঞানিক নয় এবং অরাবল্লির প্রকৃত ভূপ্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্রকে প্রতিফলিত করে না।
পরিবেশ নীতি গবেষক দেবাদিত্য সিনহা জানান, ১০০ মিটার কাট-অফ নির্ধারণ করতে গিয়ে কমিটি গাণিতিক গড় বা ‘অ্যাভারেজ’ ব্যবহার করেছে, যা উচ্চ বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূ-উচ্চতার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর। তাঁর মতে, median বা সম্পূর্ণ elevation range ব্যবহার না করে এইভাবে একটি সংখ্যার ওপর নির্ভর করা পাহাড়ের বাস্তব অবস্থানকে বিকৃত করে।
এই আশঙ্কাকে আরও জোরালো করে Indian Express-এর একটি প্রতিবেদন। সেখানে ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অভ্যন্তরীণ নথির উল্লেখ করে বলা হয়, রাজস্থানে ২০ মিটার বা তার বেশি উচ্চতার ১২,০৮১টি পাহাড় রয়েছে, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ১,০৪৮টি পাহাড় ১০০ মিটারের বেশি। অর্থাৎ নতুন সংজ্ঞা কার্যকর হলে রাজস্থানের প্রায় ৯১ শতাংশ পাহাড় অরাবল্লির বাইরে চলে যেতে পারে। উল্লেখযোগ্যভাবে, ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়া নিজে এমন সংজ্ঞা ব্যবহার করে না যা স্থানীয় relief-এর ওপর নির্ভরশীল।
এই বিষয়টি আদালতে তোলেন এক মামলাকারী। তাঁর মতে, ১০০ মিটারের নিচের পাহাড়গুলো খননের জন্য খুলে গেলে অরাবল্লির ধারাবাহিকতা ও পরিবেশগত অখণ্ডতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আদালতের আদেশে এই আশঙ্কার উল্লেখ থাকলেও শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের যুক্তিকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়।
তবে কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী ভূপেন্দর যাদব বারবার দাবি করেছেন, নতুন সংজ্ঞা অরাবল্লিকে দুর্বল করবে না, বরং আরও সুরক্ষিত করবে। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, অরাবল্লির ৯০ শতাংশেরও বেশি এলাকা সংরক্ষিত থাকবে এবং মাত্র ০.১৯ শতাংশ এলাকায় শর্তসাপেক্ষ খননের সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেছেন, দিল্লিতে কোনও খনন অনুমোদিত নয় এবং অবৈধ খনন সরকার বরদাস্ত করে না।
এই দাবির সমর্থনে গত এক সপ্তাহে নজিরবিহীন সরকারি প্রচার দেখা গেছে। প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো, পরিবেশ মন্ত্রক, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক একাধিক বিবৃতি ও ভিডিও প্রকাশ করেছে। ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়াও সোশ্যাল মিডিয়ায় জানায়, তারা এমন কোনও সমীক্ষা করেনি যাতে বলা হয়েছে যে অরাবল্লির ৯০ শতাংশ পাহাড় অসুরক্ষিত হয়ে পড়বে। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব ও রাজ্য নেতারাও সোশ্যাল মিডিয়ায় বিরোধীদের ‘ভ্রান্ত তথ্য ছড়ানো’র অভিযোগ করেছেন।
এই তৎপরতার কারণ হিসেবে উঠে এসেছে রাজস্থানে ছড়িয়ে পড়া ব্যাপক আন্দোলনের কথা। গত কয়েক দিনে যোধপুর, উদয়পুর, সিকারসহ একাধিক শহরে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। আইনজীবী, পরিবেশকর্মী ও সাধারণ নাগরিকদের অভিযোগ, নতুন সংজ্ঞা কার্যকর হলে অরাবল্লিতে বৈধ ও অবৈধ, উভয় ধরনের খননই বাড়বে।
বিরোধী দলগুলিও আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট পরিবেশমন্ত্রীর ০.১৯ শতাংশের হিসাবকে ‘বিভ্রান্তিকর’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। কংগ্রেস নেতা সচিন পাইলট ঘোষণা করেছেন, তিনি ২৬ ডিসেম্বর জয়পুরে ‘Save Aravalli’ পদযাত্রায় অংশ নেবেন। সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব বলেছেন, অরাবল্লি ধ্বংস হলে দিল্লির দূষণ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে।
কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ প্রশ্ন তুলেছেন, খননের শতাংশ নির্ণয়ে যে ১.৪৪ লক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকা ধরা হয়েছে, তা আসলে চারটি রাজ্যের অরাবল্লি-সংলগ্ন পুরো জেলার আয়তন। তাঁর মতে, প্রকৃত অরাবল্লি এলাকার তুলনায় এই হিসাব অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতিকে আড়াল করছে।
নাগরিক সংগঠন ‘অরাবল্লি বিরাসত জন অভিযান’ সরকারের কাছে স্পষ্ট তথ্য চেয়েছে- অরাবল্লির মোট পাহাড় কত, নতুন সংজ্ঞায় কতগুলো বাদ পড়বে এবং প্রকৃতপক্ষে কতটা এলাকা খননের ঝুঁকিতে পড়বে। এখনও পর্যন্ত এই প্রশ্নগুলির কোনও নির্দিষ্ট জবাব পাওয়া যায়নি।
পরিবেশবিদদের মতে, অরাবল্লি শুধু কিছু বিচ্ছিন্ন পাহাড় নয়, এটি একটি সমগ্র বাস্তুতন্ত্র, যা জলাধার, চারণভূমি, জীববৈচিত্র্য এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। খনি শ্রমিকদের জীবিকার প্রশ্ন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ অরাবল্লির ওপর নির্ভরশীল অসংখ্য গ্রামীণ মানুষের জীবন ও ভবিষ্যৎ, যাঁদের কথা এই বিতর্কে প্রায় অনুচ্চারিতই থেকে যাচ্ছে।
