আজকাল ওয়েবডেস্ক: ২০২৫ সালের ১৪ নভেম্বরের ফলাফল প্রশান্ত কিশোরকে এক অস্বস্তিকর বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। বহুদিন ধরে তিনি ভারতের নির্বাচনী কৌশলের প্রধান মস্তিষ্ক হিসেবে পরিচিত ছিলেন—ডেল কার্নেগির চেয়েও বেশি দক্ষভাবে বন্ধু বানানো ও মানুষকে প্রভাবিত করার শিল্প তিনি রপ্ত করেছিলেন বলে অনেকে মনে করতেন। কিন্তু বিহার ভোটের ফলাফলে তিনি যেন আর রাজনীতির অদম্য কৌশলী নন, বরং পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম-এর বর্তমান অবস্থার প্রতিচ্ছবি—সোশ্যাল মিডিয়ায় তুমুল উপস্থিতি, তীব্র রাজনৈতিক ভাষা, মাটিতে আন্দোলনের জোর, কিন্তু ভোটবাক্সে সাফল্য শূন্য।
মোদি থেকে রাহুল, জগন থেকে মমতা—সবাইয়েরই কৌশলবিদ ছিলেন কিশোর
প্রশান্ত কিশোরের উত্থানের গল্প সবার জানা। নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী আসনে পৌঁছে দেওয়ার পেছনে তার বড় ভূমিকা ছিল। পরবর্তীতে তিনি রাহুল গান্ধীর সঙ্গে কাজ করেন—যদিও কংগ্রেসকে ক্ষমতায় তুলতে না পারলেও তিনি দলের জাতীয় বার্তা ধারালো করার চেষ্টা করেন। আজ রাহুল যে হাঁটতে হাঁটতে আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছেন, সেই ভাবনার সূচনা অনেকেই কিশোরের কাছে খুঁজে পান।
জগন মোহন রেড্ডির দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাকে বিপুল জয়ে পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছিলেন কিশোর। ২০২১-এ তৃণমূলের ঐতিহাসিক জয়ের পেছনেও ছিল কিশোরের কৌশল।
ক্ষমতার আসন ছেড়ে ময়দানে নিজস্ব দল
এই ব্যক্তি, যিনি ভারতের রাজনৈতিক প্রচারকে আধুনিক করেছিলেন, যিনি ডেটা-ভিত্তিক প্রচারকে মূলধারায় এনেছিলেন, তিনি ঠিক করলেন আর পর্দার আড়ালে থেকে রাজনীতি করা নয়। ২০২৪ সালের ২ অক্টোবর তিনি জন সুরাজ পার্টি গঠন করেন—জাতীয় দলগুলোর প্রস্তাব ফিরিয়ে।
তিন বছর ধরে তিনি হাঁটলেন—বিহারের ৩,০০০ কিলোমিটার জুড়ে। মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনে দল গঠন, চম্পারণ থেকে যাত্রা শুরু, বেকারত্ব ও অভিবাসনের প্রশ্ন—সব কিছুই ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত। মাঠের রিপোর্ট বলছিল, বিহারের জেন জি ও তরুণ ভোটারদের মধ্যে তিনি নতুন এক আশার মুখ হয়ে উঠেছেন।
নির্বাচনের আগে ভবিষ্যদ্বাণী—আর সেখানেই ঘটল বিভ্রাট
নির্বাচনের দিন যত এগিয়ে আসছিল, কিশোর শুরু করলেন যা তিনি সবসময়ই করেন—ফলাফল ভবিষ্যদ্বাণী।
NDA “চলে যাচ্ছে”
নীতিশ কুমার “ফিরবেন না”
জেডিইউ “২৫ আসনও পাবে না”
কিন্তু ফল গণনা শুরু হতেই সব অনুমান ভেঙে পড়ল।
বিহারে শূন্য-ফল: ২৩৯ আসনে লড়েও একটি নয়
জন সুরাজ পার্টি ২৪৩টির মধ্যে ২৩৯টি আসনে লড়াই করে।
ফল: শূন্য।
নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দলটি ‘Others’—অন্যদের—তালিকায় পড়ে। এই তালিকায় নির্দলসহ মোট ভোট ১৩.৮%, প্রায় ৩৮ লক্ষ।
যেখানে কিশোর হয়ে উঠলেন ‘বঙ্গের সিপিএম’-এর মতো
পশ্চিমবঙ্গের সিপিএমের মতোই জন সুরাজও বিশাল ডিজিটাল প্রভাব তৈরি করেছিল। সিপিএম-এর বিখ্যাত নেতারা—বিমান বসু থেকে শুরু করে মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় বা সৃজন ভট্টাচার্য—রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে সমস্যার কথা তুলেছেন। তারা বেকারত্ব, দুর্নীতি, উন্নয়নের প্রশ্ন তুলে ধরেন—কোনও ধর্মীয় উস্কানি নয়, কোনও সস্তা জনপ্রিয়তাও নয়।
দীর্ঘ আগে থেকেই সিপিএম বুথ-স্তরের তথ্য, তীক্ষ্ণ স্লোগান, নির্বাচনী বয়ান—এসবের ওস্তাদ। আর ‘বৈজ্ঞানিক রিগিং’—যা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একসময় কটাক্ষ করেছিলেন—সেই শিল্পও তারা পরিপূর্ণ করেছিল বহু আগে।
প্রশান্ত কিশোর ভোটার তালিকা সংশোধন প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ তুলে বিজেপির বিরুদ্ধে ‘ভোট চুরি’-র অভিযোগ এনেছিলেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফল বলল—প্রচুর সোশ্যাল মিডিয়া প্রভাব, অগণিত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ, হাঁটাহাঁটি—কিছুই ভোটে পরিণত হল না।
চমক: সিপিএম নিজেই বিহারে একটি আসন পেল
বড় বিদ্রূপ হলো—যে সিপিএমকে “ডিজিটাল প্রভাব কিন্তু জিরো আসন” হিসেবে ধরা হয়, সেই দলই বিহারে এবার একটি আসন জিতে নিল।
আর প্রশান্ত কিশোর, তিন বছরের হাঁটা ও এক বছরের দলগঠনের পর, রয়ে গেলেন শূন্যে।
