আজকাল ওয়েবডেস্ক: গ্রাম জুড়ে ১৮০টি বাড়ি। দেশভাগের পর ওড়িশায় ঠাঁই নিয়েছিলেন একদল বাঙালি। ক্রমেই গ্রামে বাঙালিদের বসবাস বাড়তে থাকে। যার জন্য নাম, 'বাঙালি গ্রাম'। সেই গ্রামের ১৬৩টি বাড়িই তছনছ। পুড়ে খাক। অবশিষ্ট আর কিছুই নেই। গোটা গ্রাম শুনশান। একজন বাসিন্দাও নেই সেখানে। কেউ অন্য জেলায় পালিয়েছেন, কেউ বা আত্মীয়ের বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছেন, কেউ আবার অন্য রাজ্যেই পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। 

ওড়িশার মালকানগিরি জেলার এমভি-২৬ গ্রাম। ওই গ্রামের বাসিন্দা গৌরাঙ্গ কর্মকার জানিয়েছেন, দেশভাগের পর ওড়িশার এই গ্রামেই তাঁরা থাকতে শুরু করেন। ভারতের নাগরিক তাঁরা। ভোটার কার্ড রয়েছে। গত ৫০ বছরে এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হননি তাঁরা। গ্রামে পুলিশের টহলদারি সত্ত্বেও, আতঙ্কেই আর কেউ থাকতে রাজি নন। 

এদিকে আদিবাসী গ্রামের বাসিন্দা ও বাঙালি গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনার পর প্রশাসনের দাবি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কিন্তু বাস্তবের চিত্রটা আলাদা। সোমবার ওড়িশা সরকারের তরফে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে আরও নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়েছে। গতকাল রাতে ঘোষণা করা হয়েছে, মালকানগিরি জেলায় আরও ১৮ ঘণ্টা ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, এক্স হ্যান্ডেল ব্যবহার করা যাবে না। বুধবার বেলা ১২টা পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা জারি থাকবে। পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এলে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে সরকার। 

স্থানীয় প্রশাসনের তরফে আরও ঘোষণা করা হয়েছে, মৃত আদিবাসী মহিলার ছেলেকে ৩০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরের তরফেও আরও চার লক্ষ টাকা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা করা হয়েছে। সোমবার ময়নাতদন্তের পর আদিবাসী মহিলার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। যদিও এখনও পর্যন্ত ওই মহিলার মুণ্ডুটি পাওয়া যায়নি। স্নিফার ডগ নিয়ে তল্লাশি অভিযান চলছে। 

প্রসঙ্গত, আদিবাসী প্রৌঢ়ার মুণ্ডুহীন দেহ উদ্ধার হয়েছিল দিন কয়েক আগে। যা ঘিরেই তুমুল উত্তেজনা ছড়ায় দুই গ্রামে। বাঙালি গ্রামে পরপর বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে। দুই গ্রামের সংঘর্ষের জেরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি ওড়িশায়। মঙ্গলবার বন্ধ ছিল ইন্টারনেট পরিষেবাও। 

সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা, গত ২ ডিসেম্বর পোতেরু নদী থেকে পদিয়ামি (৫৫) নামের এক আদিবাসী প্রৌঢ়ার মুণ্ডুহীন দেহ উদ্ধার করা হয়। রাখেলগুড়া গ্রামের কোয়া আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। সেই নদীর পাশেই রয়েছে সুকুমার মণ্ডল নামে এক বাঙালি কৃষকের জমি। আদিবাসী গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, পদিয়ামিকে অপহরণ করে খুন করেছেন সুকুমার ও তাঁর পরিচিতরা। কারণ দীর্ঘদিন ধরেই জমি সংক্রান্ত বিষয়ে সুকুমারের সঙ্গে পদিয়ামির মনোমালিন্য ছিল। সেই কারণেই তাঁকে খুন করেছেন। 

যদিও আদিবাসী প্রৌঢ়াকে খুনের অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন সুকুমার মণ্ডল। গত রবিবার ওই বাঙালি গ্রামে হামলা চালায় আদিবাসীরা। পরপর বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। পুড়ে খাক হয়ে যায় গোটা গ্রামের অধিকাংশের বেশি বাড়ি। বাঙালিরাও আতঙ্কে ঘরছাড়া। মালকানগিরির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিনোদ পাটিল জানিয়েছেন, অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। শুভরঞ্জন মণ্ডল নামে এক ব্যক্তিকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। কিন্তু পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। 

সোমবার সন্ধ্যায় ওড়িশার সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয়, আগামী ২৪ ঘণ্টা মালকানগিরি জেলায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকবে। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সরকারের তরফে আরও জানানো হয়েছে, পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে, সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ভুয়ো খবর ছড়ানো ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্য। ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ ছিল এই জেলায়। 

সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, রবিবারের পর সোমবারেও মালকানগিরির এমভি-২৬ গ্রামে আদিবাসীরা আবারও হামলা চালায়। আরও একাধিক বাড়িতে ভাঙচুর করে, আগুন জ্বালিয়ে দেয়।‌ আতঙ্কেই ঘর ছেড়ে পালিয়ে যান বাঙালিরা। এই গ্রামেই কার্ফু জারি করে প্রশাসন। 

সূত্রের খবর, রবিবারের পর সোমবার সন্ধ্যায় পুলিশের উপস্থিতিতেই হামলা করে আদিবাসীরা। কমপক্ষে পাঁচ হাজার আদিবাসী বাসিন্দা হামলা চালিয়েছে বলে জানা গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য গোটা এলাকায় দমকল বাহিনী, বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন রয়েছে।