আজকাল ওয়েবডেস্ক: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বুধবার এক সাংবাদিক বৈঠকে দাবি করেছেন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাকে আশ্বাস দিয়েছেন, ভারত রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করবে। তবে নয়াদিল্লি সরাসরি এই দাবির জবাব না দিয়ে জানিয়েছে, ভারতের জ্বালানি নীতি “বিস্তৃত উৎস ও বৈচিত্র্যময় জ্বালানি সংগ্রহ”-এর উপর নির্ভরশীল।

হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সামনে ট্রাম্প বলেন, “আমি খুশি নই যে ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনছে। কিন্তু আজ মোদি আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন যে তারা রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করবে। এটা একটা বড় পদক্ষেপ। এখন আমাকে চীনের ক্ষেত্রেও একই কাজ করাতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “এটা তাত্ক্ষণিকভাবে সম্ভব নয়, কিন্তু প্রক্রিয়াটি খুব শিগগিরই শেষ হবে।” ট্রাম্পের দাবি, যদি ভারত রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করে, তবে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করা আরও সহজ হবে। “তারা আমাকে আশ্বাস দিয়েছে, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রাশিয়া থেকে কেনা বন্ধ করবে, আর যুদ্ধ শেষ হলে আবার বিবেচনা করবে,” মন্তব্য করেন তিনি।

গত আগস্টে ট্রাম্প প্রশাসন ভারতীয় আমদানি পণ্যের উপর শুল্ক দ্বিগুণ করে ৫০ শতাংশে নিয়ে গেছিল, রাশিয়ার তেল কেনার প্রতিবাদে। ভারত তখন সেই পদক্ষেপকে “অন্যায্য” বলে আখ্যা দিয়েছিল, কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররাও তখনও রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি করছিল।

ট্রাম্প মোদির প্রশংসাও করেন। বলেন, “তিনি আমার বন্ধু। আমাদের সম্পর্ক খুব ভালো। তিনি একজন মহান নেতা, আর তিনি ট্রাম্পকে ভালোবাসেন — তবে দয়া করে এটা ভুলভাবে নেবেন না, আমি তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নষ্ট করতে চাই না।” মোদির নেতৃত্বে ধারাবাহিকতার কথাও উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, “প্রতিবছর এক নতুন নেতা আসত, কিন্তু আমার বন্ধু বহু বছর ধরে সেখানে আছেন।”

আরও পড়ুন: সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির দিকে জুতো ছোড়া: সামাজিক মাধ্যমে ‘অসংযত প্রতিক্রিয়া’ নিয়ে সতর্ক করল আদালত

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের  মুখপাত্র রন্ধির জয়সওয়াল বৃহস্পতিবার বলেন, “স্থিতিশীল জ্বালানি মূল্য ও নিরাপদ সরবরাহ নিশ্চিত করা সবসময়ই ভারতের জ্বালানি নীতির মূল লক্ষ্য। এই নীতির অংশ হিসেবে আমরা আমাদের জ্বালানি আনার উৎসগুলিকে বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় রাখার চেষ্টা করি।”

তিনি আরও জানান, গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের জ্বালানি সহযোগিতা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বর্তমান প্রশাসনের সঙ্গেও আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। “আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো অস্থির আন্তর্জাতিক  জ্বালানি পরিস্থিতিতে ভারতীয় ভোক্তার স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা,” বলেন জয়সওয়াল। পর্যবেক্ষকদের মতে, পররাষ্ট্র মন্ত্রকের “বৈচিত্র্য” শব্দটির ব্যবহার ইঙ্গিত দেয় যে নয়াদিল্লি হয়তো ধীরে ধীরে রাশিয়ার উপর নির্ভরতা কমানোর পথে হাঁটছে।

হেলসিঙ্কির Centre for Research on Energy and Clean Air (CREA)-এর সেপ্টেম্বর ২০২৫-এর এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ভারত সেই মাসে ৩.৬ বিলিয়ন ইউরো মূল্যের রাশিয়ান জীবাশ্ম জ্বালানি কিনেছে, যার মধ্যে প্রায় ৭৭ শতাংশ ছিল অপরিশোধিত তেল। ডিসেম্বর ২০২২ থেকে ভারত রাশিয়ার মোট তেল রপ্তানির প্রায় ৩৮ শতাংশ কিনেছে — যা চীনের পরেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

তবে সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ভারতের ক্রয় প্যাটার্নে পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। Kpler-এর রিয়েল-টাইম সামুদ্রিক তথ্য অনুযায়ী, জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানিগুলি রাশিয়ান তেল কেনা ৪৫ শতাংশ কমিয়েছে — জুনে প্রতিদিন ১.১ মিলিয়ন ব্যারেল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে তা নেমে এসেছে ৬ লক্ষ ব্যারেলে।

অন্যদিকে, বেসরকারি সংস্থাগুলি যেমন রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ ও রসনেফট-সমর্থিত নয়ারা এনার্জি তাদের আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে রিলায়েন্সের রাশিয়ান তেল আমদানি বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৮.৫ লক্ষ ব্যারেল প্রতিদিন — জানুয়ারির তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি, আর নয়ারা আমদানি করে প্রায় ৪ লক্ষ ব্যারেল প্রতিদিন, যা এ বছর তাদের সর্বোচ্চ।

ট্রাম্পের মন্তব্য ঘিরে ভারতে রাজনৈতিক ঝড় উঠেছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এক্স-এ পোস্ট করে অভিযোগ করেন যে প্রধানমন্ত্রী “ট্রাম্পকে ভয় পান” এবং “ভারতের তেল নীতির সিদ্ধান্ত ট্রাম্পকে ঘোষণা করতে দিয়েছেন।” রাহুল গান্ধী আরও বলেন, মোদি সরকারের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক নীরবতা — যেমন শার্ম এল শেখ গাজা শান্তি সম্মেলনে মোদির অনুপস্থিতি এবং অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের ওয়াশিংটন সফর বাতিল — প্রমাণ করে যে তারা প্রকাশ্যে ট্রাম্পের মুখোমুখি হতে চাইছেন না।

কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশও কটাক্ষ করে বলেন, “মোদি আমেরিকার হাতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আউটসোর্স করেছেন।” তার অভিযোগ, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওই প্রথম ‘অপারেশন সিঁদুর’ বন্ধের ঘোষণা করেছিলেন, আর ট্রাম্প এর পর থেকে “পাঁচটি দেশে ৫১ বার দাবি করেছেন যে তিনি চাপ দিয়ে এই সিদ্ধান্ত করিয়েছেন।”

ট্রাম্পের দাবি আপাতত ভারতের সরকার সরাসরি অস্বীকার না করলেও, পররাষ্ট্র মন্ত্রকের বক্তব্যে যে সুর, তা ইঙ্গিত দিচ্ছে — নয়াদিল্লি রাশিয়ার উপর নির্ভরতা কমিয়ে ধীরে ধীরে একটি বহুমুখী জ্বালানি কৌশলের পথে এগোচ্ছে। তবে রাজনৈতিকভাবে এই ইস্যু আগামী দিনে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিতর্কের কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।