আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি দেশের প্রতিরক্ষা খাতে অন্যতম বৃহত্তম প্রযুক্তিগত রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকারি তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে দেশের মোট প্রতিরক্ষা উৎপাদন পৌঁছেছে ১,২৭,৪৩৪ কোটি টাকায়, যার প্রায় ৬৫ শতাংশই এখন দেশীয়ভাবে উৎপাদিত। এক দশক আগেও যেখানে ৬৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানির উপর নির্ভরশীল ছিল, সেখানে আজ ভারত সেই পরিস্থিতিকে পুরোপুরি উল্টে দিয়েছে।
ক্ষেপণাস্ত্রই এখন ভারতের সবচেয়ে দেশীয়করণ-সমৃদ্ধ অস্ত্রশ্রেণি—অনুমান অনুযায়ী ৮০ শতাংশেরও বেশি উপাদান বর্তমানে ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি হচ্ছে। যদিও অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্র ডিজাইন ও উন্নয়ন করে ডিআরডিও, তবে উৎপাদন ও মোতায়েন এখন আরও বৃহৎ ইকোসিস্টেম—ডিফেন্স পিএসইউ ও বেসরকারি শিল্পের হাতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ভারতের স্ট্র্যাটেজিক বলিস্টিক ক্ষমতার মূল কেন্দ্রস্থল হল অগ্নি ক্ষেপণাস্ত্র পরিবার। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, অগ্নি-প্রাইম ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রেল-মোবাইল লঞ্চার ব্যবহার করে সম্পূর্ণ অপারেশনাল কনফিগারেশন পরীক্ষায় সফল হয়। অগ্নি সিরিজের দেশীয় উপাদান এখন আনুমানিক ৯০ শতাংশে পৌঁছেছে—গাইডেন্স, কম্পোজিট মোটর কেসিং থেকে শুরু করে প্রপালশন পর্যন্ত বেশিরভাগই এখন দেশে তৈরি। অগ্নি-V, যার পাল্লা ৫,০০০ কিলোমিটারেরও বেশি, ভারতের পারমাণবিক প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রধান স্তম্ভ। অগ্নি-I এবং অগ্নি-II অপেক্ষাকৃত কম দূরত্বের কৌশলগত পাল্লা সামলায়।
অন্যদিকে, পৃথ্বী ক্ষেপণাস্ত্র পরিবার রয়েছে বলিস্টিক ব্যবস্থার ট্যাকটিক্যাল দিকটিতে। ২০২৫ সালের জুলাই মাসে পৃথ্বী-II এবং অগ্নি-I–এর সফল ইউজার ট্রায়াল সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি আরও দৃঢ় করেছে। পৃথ্বী-II প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার পাল্লার উচ্চ-নির্ভুল আঘাত হানতে সক্ষম। পৃথ্বী-III মূলত নৌবাহিনী ও নৌ-উড়োজাহাজের ট্যাকটিক্যাল ব্যবহারের জন্য। পৃথ্বী সিরিজে দেশীয়করণ প্রায় ৮৫ শতাংশ—আগে কিছু নির্দিষ্ট গাইডেন্স কম্পোনেন্ট আমদানি করতে হত, সেগুলিও এখন ভারতেই তৈরি হচ্ছে।
ভারত-রাশিয়া যৌথ উদ্যোগে তৈরি ব্রহ্মোস সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল ভারতের সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ অস্ত্রব্যবস্থার মধ্যে অন্যতম। যেহেতু এটি যৌথ উন্নয়ন, তাই বর্তমানে এর দেশীয়করণ স্তর আনুমানিক ৭০ শতাংশ। তবে ভারত নিজস্ব সিকার, প্রপালশন কম্পোনেন্ট ও কন্ট্রোল সিস্টেমের উৎপাদন দ্রুত বাড়াচ্ছে। লখনউ কমপ্লেক্স ২০২৬ সালের মধ্যে বছরে ১০০–১৫০টি ব্রহ্মোস তৈরির সক্ষমতা অর্জন করবে বলে আশা। সমুদ্র, স্থল ও আকাশ—তিন মাধ্যমেই ব্রহ্মোস মোতায়েনযোগ্য, যা এটিকে ভারতের অন্যতম শক্তিশালী আঘাত-ক্ষমতা ও রপ্তানি সম্ভাবনাময় সিস্টেমে পরিণত করেছে।
ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে সর্বোচ্চ দেশীয় সাফল্য দেখা যায় আকাশ সামরিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়। আকাশ ক্ষেপণাস্ত্রের দেশীয় উপাদান প্রায় ৯৬ শতাংশ—ভারতের মধ্যে সর্বাধুনিক একাধিক এয়ার ডিফেন্স রেজিমেন্টে এটি স্থাপন করা হয়েছে। ২০২৫ সালের আগস্টে কিউআরএসএএম, ভিশোরাডস, উচ্চ-ক্ষমতা সম্পন্ন লেজার-ভিত্তিক ডিরেক্টেড এনার্জি ওয়েপন (DEW)–সহ সমন্বিত বায়ুরক্ষা ব্যবস্থার ফ্লাইট-টেস্ট সফল হয়েছে। এর ফলে ভারত আর পুরনো রুশ S-125 বা ইসরায়েলি আপগ্রেডের উপর নির্ভরশীল নয়।
পিনাকা রকেট সিস্টেম, গাইডেড আর্টিলারি, লয়টারিং মিউনিশন এবং রুদ্রাম অ্যান্টি-রেডিয়েশন মিসাইল—সব ক্ষেত্রেই দেশীয় উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৪,০০০টিরও বেশি কম্পোনেন্ট এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে, এবং ৩,০০০টির বেশি উপাদানের আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিশেষত পিনাকা এখন ভারতের অন্যতম সফল দেশীয় রকেট সিস্টেম ও রপ্তানি আকর্ষণের কেন্দ্র।
২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,৫০,৫৯০ কোটি টাকায়, আর প্রতিরক্ষা রপ্তানি পৌঁছেছে ২৩,৬২২ কোটি টাকায়—ভারতীয় ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ক্রুজ ও গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রই রপ্তানির প্রধান অংশ। সিকার, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার স্যুট ও প্রপালশন—এসব উপ-ব্যবস্থায় দেশীয় সক্ষমতা বাড়ায় প্রোটোটাইপ থেকে সিরিয়াল উৎপাদনে গতি এসেছে।
অগ্নি থেকে পৃথ্বী, আকাশ থেকে ব্রহ্মোস—আজ ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডারের বড় অংশই তৈরি হয় দেশেই।
দেশীয়করণের হার বড় পরিবারগুলিতে ৭০ থেকে ৯৬ শতাংশের মধ্যে। এই রূপান্তর কেবল প্রতীকী নয়—ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পের কাঠামোগত পুনর্গঠনের ইঙ্গিত। তবু সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরতার জন্য আরও বৃহৎ উৎপাদন ক্ষমতা, শক্তিশালী ভেন্ডর বেস এবং দীর্ঘমেয়াদি রপ্তানি সক্ষমতা গড়ে তোলা এখন ভারতের সামনে বড় লক্ষ্য।
