আজকাল ওয়েবডেস্ক:  কেন্দ্রীয় সরকার চারটি নতুন শ্রম কোড প্রণয়ন করেছে, যা পূর্বের বহু শ্রম আইনকে এক কাঠামোর আওতায় এনেছে। এই চারটি কোড হলো— কোড অন ওয়েজেস (২০১৯), ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন্স কোড (২০২০), কোড অন সোশ্যাল সিকিউরিটি (২০২০), এবং অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশনস কোড (২০২০)। সরকার দাবি করেছে, এই পরিবর্তনে শ্রমআইন আরও আধুনিক ও শ্রমিক বান্ধব হবে। তবে বাস্তবে শ্রমিক সংগঠনসহ বহু বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে এই কোড শ্রমিক অধিকারকে সংহত করার পরিবর্তে সীমিত করছে।

২০১৯ সালের কোড অন ওয়েজেস আইন চালুর সঙ্গে সঙ্গে  পেমেন্ট অব ওয়েজেস অ্যাক্ট (১৯৩৬), মিনিমাম ওয়েজেস অ্যাক্ট (১৯৪৮), পেমেন্ট অব বোনাস অ্যাক্ট (১৯৬৫), এবং ইক্যুয়াল রিমুনারেশন অ্যাক্ট (১৯৭৬)—এই চারটি পৃথক আইন বাতিল হয়েছে। নতুন আইনে সর্বনিম্ন মজুরি সংক্রান্ত বিধি আরও বিস্তৃত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে এখন থেকে সকল শ্রমিক সর্বনিম্ন মজুরির আওতায় আসবেন। আগে এটি কেবল নির্দিষ্ট "তফসিলভুক্ত কর্মসংস্থান"-এ সীমাবদ্ধ ছিল।

এই কোডে "ন্যাশনাল ফ্লোর ওয়েজ" বা জাতীয় সর্বনিম্ন মজুরির ধারণা আনা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার এটি নির্ধারণ করবে এবং কোনও  রাজ্যই তার নিচে মজুরি নির্ধারণ করতে পারবে না। কোড অনুযায়ী দক্ষতা, কর্মের ধরন, পরিশ্রম  এবং এলাকা—মহানগর, অ-মহানগর বা গ্রাম—এই মানদণ্ডে মজুরি নির্ধারিত হবে এবং প্রতি পাঁচ বছরের মধ্যে তা পুনর্বিবেচনা করতে হবে।

তবে এই পরিবর্তন যে সব শ্রমিককে অন্তর্ভুক্ত করছে তা নিশ্চিত নয়। কারণ আইন অনুযায়ী সর্বনিম্ন মজুরি সেই সব শ্রমিকদের জন্য প্রযোজ্য হবে, যারা কোনও  “এস্টাব্লিশমেন্ট”— অর্থাৎ ব্যবসা, শিল্প, বাণিজ্য বা উৎপাদন সংক্রান্ত স্থানে কাজ করেন। এই সংজ্ঞার ফলে গৃহভিত্তিক শ্রম, পারিবারিক কৃষি শ্রমিক, বহু ক্ষুদ্র উৎপাদন শ্রমিক এখনো আইনি সুরক্ষার বাইরে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আগে বিভিন্ন পেশার জন্য আলাদা আলাদা সর্বনিম্ন মজুরি হার নির্ধরণ করা হত। অনেক ক্ষেত্রেই অ-সংগঠিত শ্রমবাজারে পেশাভিত্তিক সর্বনিম্ন মজুরি ছিল শ্রমিকদের ন্যূনতম দরকষাকষির শক্তি। কিন্তু নতুন আইনে পেশাভিত্তিক হার বাতিল করে অঞ্চল ও দক্ষতা অনুযায়ী চারটি সরল শ্রেণিবিভাগ তৈরি করা হয়েছে। এতে প্রশাসনিক সুবিধা ও আইন বাস্তবায়ন সহজ হতে পারে, তবে শ্রমিকদের দরকষাকষির ক্ষমতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

প্রয়োগ বা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও বড় পরিবর্তন এসেছে। আগে শ্রম পরিদর্শক সরাসরি কর্মস্থলে গিয়ে নথি যাচাই করতে পারতেন। নতুন আইনে এই ব্যবস্থা অনেকাংশে ওয়েব-ভিত্তিক রিপোর্ট ও self-certification-এর উপর নির্ভরশীল। পরিদর্শকের ভূমিকা এখন “ইন্সপেক্টর কাম ফ্যাসিলিটেটর”, অর্থাৎ তিনি পরিদর্শনের চেয়ে নির্দেশনা দেওয়ার ভূমিকা বেশি পালন করবেন। যদিও আইন ভঙ্গের ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে, অ-সংগঠিত শ্রমবাজারে শ্রমিকদের অভিযোগ জানানো বা ন্যায্য বেতন আদায়ের পথ এখনও জটিল।

এই কারণে, দ্যা ওয়্যার-এর প্রতিবেদন অনুসারে, দেশজুড়ে শ্রমিক ইউনিয়নগুলো প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তাদের অভিযোগ, এই কোড শ্রমিক নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবি করলেও, বাস্তবে তা শ্রমিক সুরক্ষা দুর্বল করছে এবং নিয়োগকর্তাদের হাতে বেশি ক্ষমতা দিচ্ছে।

ভারতের অভিজ্ঞতা ইঙ্গিত দেয় যে শুধু কাগজে অধিকার দেওয়া যথেষ্ট নয়—কঠোর প্রয়োগই শ্রমিক সুরক্ষার আসল ভিত্তি। নতুন কোড কভারেজ বাড়ালেও প্রয়োগ প্রক্রিয়া দুর্বল হওয়ায় শ্রমিকরা বাস্তবে কতটা উপকৃত হবেন তা এখনো অনিশ্চিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, মজুরি নির্ধারণের পদ্ধতি আরও স্বচ্ছ করতে হবে এবং প্রয়োগ ক্ষেত্রকে শক্তিশালী না করলে এই নতুন কাঠামো শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হবে।

নতুন শ্রম কোড বাস্তবায়ন হলে তা শ্রমবাজারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে, তাই সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের পর্যাপ্ত আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার মান এবং তাদের অধিকার বাস্তবে নিশ্চিত করতে সরকারকে আইন প্রয়োগের পদ্ধতি আরও দৃঢ় ও কার্যকর করতে হবে—এমনই দাবি উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে।