আজকাল ওয়েবডেস্ক: সম্প্রতি রাস্তায় থাকা কুকুরদের আট সপ্তাহের মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তরের জন্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ জারি হয়েছে। এই নির্দেশ মানতে গিয়ে রাজ্য সরকার ও পুরসভাগুলি রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। দেখা গিয়েছে, পশু জন্ম নিয়ন্ত্রণ (Animal Birth Control বা ABC) কেন্দ্র এবং ভেটেরিনারি হাসপাতালগুলি ন্যূনতম পরিকাঠামো, সীমিত সম্পদ এবং সরকারি সংস্থার কাছ থেকে বকেয়া অর্থ না পাওয়ার সমস্যায় জর্জরিত।
সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০টি এবিসি (ABC) কেন্দ্রের মধ্যে ৭টিতে গিয়ে যে চিত্র পাওয়া গিয়েছে, তা বেশ উদ্বেগজনক। ডাক্তার ও এনজিও কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ প্রবল, কারণ তাঁরা এই আদেশকে কার্যত অসম্ভব মনে করছেন।
সূত্রে জানা গিয়েছে, লালকেল্লার কাছে অবস্থিত একটি কেন্দ্রে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন অব দিল্লি (MCD) একটি মর্গের পাশে জায়গা দিয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে যশ ডমেস্টিক রিসার্চ সেন্টার নামে একটি এনজিও এই কেন্দ্রটি চালাচ্ছে। এখানে ২০টি ক্যানেল, একটি খোলা রান্নাঘর, একটি আইসোলেশন বক্স, একটি অপারেশন থিয়েটার ও একটি উন্মুক্ত এলাকা রয়েছে।
এই কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা ডাক্তার সঞ্জীব (তিনি একক নামে পরিচিত) বলেন, 'আদালত নিশ্চয় চিন্তা করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু আমাদের কাছে ১২৫টির বেশি কুকুর রাখার পরিকাঠামো নেই। কুকুরদের আমরা তিন থেকে পাঁচ দিনের বেশি রাখতে পারি না, কারণ আমাদের নতুন কুকুর নিতে হয়। আহত কুকুর, অসুস্থ কুকুর, বৃদ্ধ কুকুর, এমনকি যাদের স্টেরিলাইজ করতে হবে-সবার দায়িত্ব আমাদের। মাসে আমরা ৭৫০টির বেশি স্টেরিলাইজেশন করি, অথচ আমাদের কাছে মাত্র দুইজন ডাক্তার আছেন। এরও বেশি সার্জারি বা আশ্রয় দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।'
সঞ্জীব অভিযোগ করেন, মার্চ মাস থেকে তাদের কোনও অর্থ দেয়নি MCD। 'ভাবুন, নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করে আমরা মাসে ৭০০-৮০০টি স্টেরিলাইজেশন করছি, সার্জারি, ওষুধ, কর্মীদের বেতন, কুকুরের খাবার, অস্থায়ী আশ্রয়ের খরচ দিচ্ছি। বর্তমানে ১০৬টি কুকুর রয়েছে আমাদের এখানে। নতুন কুকুর এলে আমাদের স্টেরিলাইজেশন বন্ধ করতে হবে। আমাদের কাছে মাত্র দুটি ভ্যান আছে। ইতিমধ্যে আমরা হিমশিম খাচ্ছি, কারণ MCD আমাদের বলেছে লালকেল্লার কাছে থাকা কুকুর ধরতে ও ১৫ আগস্ট পর্যন্ত তাদের রাখার ব্যবস্থা করতে। গত দুদিনে একটি সার্জারিও করা সম্ভব হয়নি,' তিনি জানান।
উত্তর দিল্লির তিমারপুর এলাকায় অবস্থিত 'নেইবারহুড উফ' (Neighbourhood Woof) নামের একটি এনজিও দ্বারা পরিচালিত এবিসি কেন্দ্রে ৯০টি কুকুর রাখার ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে সেখানে ৮৫টি কুকুর রয়েছে। কেন্দ্রটির প্রধান আয়েশা ক্রিস্টিনা বেন বলেন, 'আমাদের বেশিরভাগ কুকুর আসে কেয়ারগিভারদের কাছ থেকে, যারা চায় কুকুরটি স্টেরিলাইজ করে তার এলাকা ফিরিয়ে দেওয়া হোক। এটি সঠিকভাবে কাজ করে কুকুর প্রতি সপ্তাহে ভর্তি হয়ে ছাড়া পেলে। এখন যদি কুকুর ছেড়েই না দেওয়া যায়, তাহলে কীভাবে চলবে?'
একজন MCD সিনিয়র অফিসার বলেন, 'আমরা ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে কিছুদিনের জন্য এবিসি কেন্দ্রগুলিকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করব এবং কুকুর ছাড়তে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা অতিরিক্ত ভিড় ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে কাজ করছি। নতুন আশ্রয় কেন্দ্র গড়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আমরা জানি জমি ও সম্পদের অভাব রয়েছে, কিন্তু আপাতত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করছি।' বকেয়া অর্থ প্রসঙ্গে ওই কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা এটি খতিয়ে দেখব। মাঝে মাঝে আবেদনকারীরা নির্দিষ্ট মানদণ্ড পূরণ না করলে অর্থ ছাড়া হয় না।'
ভেটেরিনারি ডাক্তার হরগুন সিং বলেন, 'কুকুরদের খাঁচায় বন্দি করা মানে তাদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো এবং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া। কুকুর খুব সংবেদনশীল প্রাণী। তারা যেখানে জন্মেছে বা বড় হয়েছে, সেখানেই থাকতে পছন্দ করে। হাজার হাজার কুকুরকে এমন জায়গায় রাখলে তাদের কী হবে? চিকিৎসা, স্টেরিলাইজেশন, আলাদা করে রাখা- সব কি সম্ভব? এক সময় তারা সবাই ধীরে ধীরে মারা যাবে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের অনেক কেয়ারগিভার আছেন, যারা তাদের কুকুর ফিরিয়ে নিতে চান। আমি তাদের কী বলব? যদি আমরা শুধু কুকুর রাখা শুরু করি, তাহলে স্টেরিলাইজেশন বন্ধ করতে হবে… যার ফলে টিউমার, সংক্রমণ, আগ্রাসী আচরণ বাড়বে এবং কুকুরের আয়ু কমবে। আমার মনে হয় সরকার কুকুরদের মেরে ফেলতে চাইছে।'
ফ্রেন্ডিকোস (Friendicoes) নামের একটি পশু কল্যাণ সংস্থা দিল্লিতে তিনটি এবিসি ইউনিট চালায়। এর ভাইস-প্রেসিডেন্ট গীতা সেশামণি এই আদেশকে 'প্রায় অসম্ভব' বলে মনে করেন।
তিনি বলেন, 'আসলে যে বিষয়টির সমাধান প্রয়োজন ছিল, তা হলো আক্রমণাত্মক কুকুরদের মানবিকভাবে সামলানোর জন্য একটি সঠিক প্রোটোকল, যা এবিসি নিয়মেই চলত। কিন্তু এই আদেশে সব কুকুরকেই বন্দি করার কথা বলা হচ্ছে, যদিও এদের বেশিরভাগই নির্বিষ, স্টেরিলাইজ ও টিকাকরণ করা। এখন যখন আশ্রয় কেন্দ্র নেই, বিশাল বাজেটের প্রয়োজন... এটা অসম্ভব। সম্ভবত কুকুরগুলো দিল্লির সীমান্তে ফেলে দেওয়া হবে। তাদের উপর ভয়, আতঙ্ক, ধীরে ধীরে অনাহার, রোগ এবং অবহেলা তৈরী হবে, তা ভেবে দেখুন।'
তিনি আরও জানান, 'আমরা গত ছয় মাস ধরে কোনও রকম রিম্বার্সমেন্ট ছাড়া কাজ করে যাচ্ছি।' তাদের ডিফেন্স কলোনি সেন্টারে প্রতি মাসে প্রায় ৫০০-৫৫০টি কুকুরের স্টেরিলাইজেশন করা হয়।
লাজপত নগরের অ্যানিম্যাল ইন্ডিয়া ট্রাস্ট ( Animal India Trust) কর্তৃপক্ষ জানান, তারা সর্বোচ্চ ৮০টি কুকুর রাখতে পারেন। সংস্থার ভেটেরিনারি সার্জন সারুংবম ইয়াইফাবি দেবী বলেন,'এই সিদ্ধান্তে আমি হতবাক। প্রথমত, আমাদের কে অর্থ সাহায্য করবে, তা স্পষ্ট নয়। দ্বিতীয়ত, কেউ জানেই না মোট কত কুকুর রয়েছে। আমরা একটি কুকুরকে স্টেরিলাইজ করার পর মাত্র ৫-৭ দিন রাখতে পারি। সব কুকুর তুলে নিলে ইঁদুরের উপদ্রবসহ নানা সমস্যা বাড়বে।'
বাসন্ত কুঞ্জের কাছে মাসুদপুরে দুটি ABC কেন্দ্র রয়েছে। একটি প'জ ( PAWS (Pet Animal Welfare Society)-এর পরিচালিত ক্লিনিক ও দোকান, যা MCD-এর জন্য এবিসি চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। এই কেন্দ্রটি কুকুরের খাবার এবং কখনও কখনও স্টেরিলাইজেশনের খরচও নিজে বহন করে।
এই ক্লিনিকের দায়িত্বে থাকা অমৃতা অরোরা বলেন, 'সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশ ভালো নয়। এত বেশি সংখ্যক কুকুর আশ্রয়কেন্দ্রে রাখলে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।' তিনি জানান, একটি কুকুরের মাসিক খরচ কমপক্ষে ২০,০০০। যাতে খাবার ও চিকিৎসা অন্তর্ভুক্ত। সাধারণত এখানে ১০-১৫টি কুকুর থাকে।
অপর এবিসি কেন্দ্রটি মাসুদপুরেই অবস্থিত। এটি সম্পূর্ণরূপে এমএসডি পরিচালিত একটি ভেটেরিনারি হাসপাতাল। এখানে কর্মীরা নিজেরাই কুকুর ধরেন ও স্টেরিলাইজ করেন। 'প্রতিটি কুকুরকে স্টেরিলাইজ করা উচিৎ এবং আমরা তাদের কান কেটে চিহ্ন দিয়ে থাকি যেন বোঝা যায় কাজটি সম্পন্ন হয়েছে', বলেন কেন্দ্রের এক কর্মী।
কেন্দ্রের চিকিৎসক সুপ্রিম কোর্টের আদেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, 'যদি আশ্রয়কেন্দ্রের অভাবে ধরা কুকুর অন্য এলাকায় ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেখানকার কুকুররা তাদের আক্রমণ করতে পারে। তারা কোথায় খাবার পাবে, তাও জানবে না। এতে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়বে।'
