আজকাল ওয়েবডেস্ক: মধ্যপ্রদেশের রাজগড় জেলার দারাওয়ারি গ্রামের মানুষ এক বিরল ও ব্যতিক্রমী ঘটনার সাক্ষী রইল। গ্রামটির প্রায় ৪০০০-র বেশি বাসিন্দা একত্রিত হয়ে আয়োজন করলেন একটি ‘শ্রাদ্ধ ভোজ’। তাও আবার একজন মানুষের নয়, বরং একটি বাঁদরের স্মরণে, যাকে গ্রামবাসীরা ভগবান হনুমানের অবতার বলে বিশ্বাস করেন। প্রায় ১২ দিন আগে ওই বাঁদরটি বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে পড়ে মৃত্যু হয়।
গ্রামবাসীদের কাছে বাঁদরটিকে পরিবারের সদস্যের মতোই মনে করা হতো। সেই বিশ্বাস থেকেই তার জন্য সম্পন্ন করা হয় মানুষের মতোই সব শেষকৃত্য। ৮ নভেম্বর বাঁদরটির জন্য সাজানো হয় বিশেষভাবে সাজানো চিতা। গ্রামের পুরোহিতরা মন্ত্রোচ্চার করে তাকে শ্মশানঘাট ‘শান্তি ধামে’ নিয়ে যান। বাদ্য-বাজনা, শোভাযাত্রা—সব মিলিয়ে ছিল একেবারে পূর্ণ হিন্দু রীতিতে শেষকৃত্য।
এরপর, মৃত্যুর ১১তম দিনে গ্রামবাসীরা যাত্রা করেন উজ্জয়িনীর উদ্দেশে। উদ্দেশ্য—বাঁদরটির অস্থি বিসর্জন। শিপ্রা নদীতে ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী পুরোহিতদের উপস্থিতিতে সম্পন্ন হয় এই অস্থি বিসর্জন। এমনকি প্রচলিত মানবিক রীতির প্রতীকী অংশ হিসেবে সম্পন্ন হয় “ঈশীর্ণ”—দাড়ি কাটার মতো প্রতীকী আচার এবং ১১তম দিনের অন্যান্য শাস্ত্রসম্মত ক্রিয়াকর্মও। সব মিলিয়ে, পুরো প্রক্রিয়া ছিল মানবীয় অন্ত্যেষ্টির এক নিখুঁত প্রতিচ্ছবি।
১২তম দিনে গ্রামে ফিরে গ্রামবাসীরা আয়োজন করেন বড়সড় শ্রাদ্ধের ভোজ। সমগ্র গ্রামের সকলে মিলে প্রায় ১ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করা হয় বিশাল ভোজের জন্য। প্রস্তুত করা হয় প্রায় ৫ কুইন্টাল ময়দার পুরি, ১০০ লিটার ছাছ দিয়ে তৈরি তরকারি, ১ কুইন্টাল চিনি এবং আরও নানা ধরনের নিরামিষ খাদ্য। পাশের সব গ্রামের মানুষকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং ৩০–৩৫ কিলোমিটার দূর থেকেও লোকজন উপস্থিত হন।
ঘটনাটি যতই অস্বাভাবিক শোনাক, মধ্যপ্রদেশে এর আগে এমন ঘটনা ঘটেছিল ২০২১ সালেও। রাজগড় জেলারই দলুপুরা গ্রামে ডিসেম্বরের শেষ দিকে ঠান্ডায় মারা যাওয়া একটি লাঙ্গুরের জন্য স্থানীয় বাসিন্দারা আয়োজন করেছিলেন আরেকটি ভোজ। প্রায় ১,৫০০ মানুষ উপস্থিত ছিলেন সেই ভোজে। এর আগের দিন লাঙ্গুরটিকে মানুষের মতোই শোভাযাত্রা করে দাহ করা হয়, স্তোত্রপাঠ, মন্ত্রোচ্চারণ—সবকিছু নিয়েই। এখানকার পঞ্চায়েত প্রধান অর্জুন সিং চৌহান বলেন,
“আমাদের গ্রামে বাঁদর মারা গেলে তাকে মানুষের মতোই সম্মান জানিয়ে সব শেষকৃত্য করা হয়। এটাই আমাদের প্রথা।”
এখানে গ্রামবাসীরা বাঁদরদের হনুমানের রূপ বলে মানেন। প্রকৃতই, ভারতের বহু গ্রামাঞ্চলে বাঁদরকে পবিত্র প্রাণী বলা হয় এবং তাদের প্রতি বিশেষ ভক্তি প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। হনুমানভক্তি বিশেষ করে উত্তর ও মধ্য ভারতের গ্রাম সমাজে বহুদিন ধরেই সামাজিক-ধর্মীয় ঐতিহ্যের অংশ।
দারাওয়ারির এই ঘটনা দেখিয়ে দিল—কখনও কখনও ধর্মীয় অনুভূতি কতটা গভীরভাবে মানুষের জীবন ও সংস্কৃতিতে মিশে থাকে। একটি প্রাণীর জন্য মানুষের মতো এভাবে পূর্ণ মর্যাদায় শ্রদ্ধা ও শেষকৃত্য এদেশের গ্রামবাংলার আধ্যাত্মিক ও লোকবিশ্বাসের অনন্য প্রতিচ্ছবি।
