আজকাল ওয়েবডেস্ক: শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) কেরালার স্থানীয় স্বশাসন নির্বাচনের ফল প্রকাশ হতেই রাজ্যজুড়ে রাজনৈতিক মহলে তীব্র চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে তিরুবনন্তপুরম পুরনিগমের ফলাফল কেরালার রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক মোড় এনে দেয়। প্রায় পাঁচ দশকের ইতিহাসে প্রথমবার রাজ্যের রাজধানীর পুরনিগম দখল করল বিজেপি। ১০১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫০টিতে জয় পেয়ে বিজেপি কার্যত ক্ষমতা দখল করে, যা দীর্ঘদিন ধরে এই পুরসভা শাসন করে আসা সিপিআই(এম)-এর কাছে শুধুমাত্র একটি নির্বাচনী পরাজয় নয়, বরং তাদের সবচেয়ে পুরনো শহুরে দুর্গের পতন হিসেবেই মনে করা হচ্ছে।
তবে তিরুবনন্তপুরমে গেরুয়া শিবিরের উত্থান যতটা আলো কেড়েছে, তার থেকেও গভীর ও বিস্তৃত রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে গোটা কেরালাজুড়ে। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে ওঠে রাজ্যজুড়ে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউডিএফ) কার্যত ঝড় তুলেছে। ছয়টি বড় পুরনিগমের মধ্যে চারটিই গেছে ইউডিএফের দখলে, একটি বিজেপির এবং মাত্র একটি- কোঝিকোড় আসনটি কোনওরকমে ধরে রাখতে পেরেছে বামেরা। ক্ষমতাসীন লেফট ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এলডিএফ) এই ফলাফলের মাধ্যমে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে।
সংখ্যার হিসেবেই পরিবর্তনের ইঙ্গিত ধরা পড়ে। ২০২০ সালে যেখানে বামেরা পাঁচটি পুরনিগমে দাপট বজায় রেখেছিল, ২০২৫ সালে এসে সেই আধিপত্য প্রায় নিশ্চিহ্ন। কোল্লামে টানা ২৫ বছর শাসনের পর ইউডিএফের হাতে ক্ষমতা চলে যায় ১৫ আসনের বড় ব্যবধানে। কোচি, যা কিনা রাজ্যের বাণিজ্যিক রাজধানী, ইউডিএফ ৪৭টি আসন জিতে বামেদের ২২টি আসনের তুলনায় বিপুল ব্যবধানে এগিয়ে যায়, যা ২০২০ সালের প্রায় সমান-সমান ফলাফলের সম্পূর্ণ বিপরীত। ত্রিশূরেও স্পষ্টভাবে কংগ্রেস জোটের দিকে ভোট পড়ে।
শুধু পুরনিগম নয়, পৌরসভাগুলির ফলাফলও এক ছবিই তুলে ধরে। ২০২০ সালে যেখানে এলডিএফ ৪৩টি পৌরসভা জিতেছিল, সেখানে এবার তারা নেমে এসেছে মাত্র ২৮টিতে। ইউডিএফ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪-এ। বিজেপি, যা পাঁচ বছর আগে পৌর রাজনীতিতে প্রায় অনুপস্থিত ছিল, এবার দুটি পৌরসভা জিতে নিয়েছে, তার মধ্যে ত্রিপুনিথুরা রাজনৈতিকভাবে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
বিশ্লেষকদের মতে, ১,২০০-রও বেশি স্থানীয় সংস্থা ও ২৩ হাজারের বেশি ওয়ার্ড জুড়ে এই ফলাফল এক বিরাট রাজনৈতিক পুনর্গঠনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ রাজ্যজুড়ে প্রভাব বিস্তার করেছে। অন্যদিকে বিজেপি-নেতৃত্বাধীন এনডিএ সামগ্রিক ভোট শতাংশ খুব বেশি বাড়াতে না পারলেও, কৌশলগতভাবে নির্দিষ্ট এলাকায় শক্তি বাড়িয়ে ইতিহাস গড়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ ও মধ্য কেরালার হিন্দু-প্রধান এলাকায় সংগঠনের জোরেই তারা আসন জয়ে সফল হয়েছে।
বামেদের পতনের ভৌগোলিক চিত্রও তাৎপর্যপূর্ণ। উত্তর কেরালার মুসলিম প্রধান অঞ্চল-মালাপ্পুরম, কন্নুরের অংশ ও কোঝিকোড়ে এলডিএফের বড় ধাক্কা লেগেছে। মালাপ্পুরম জেলায় ১২টির মধ্যে ১১টি পৌরসভা ইউডিএফ জিতে নিয়েছে, যেখানে আগে বামেদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল।
এই ভাঙনের পেছনে আদর্শগত বিভ্রান্তির অভিযোগ উঠছে। মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের ‘লিগ জোট’ সংক্রান্ত মন্তব্য, কেন্দ্রের পিএম-শ্রী প্রকল্পে প্রাথমিক সম্মতি এবং গ্লোবাল আয়্যাপ্পা সংগমের মাধ্যমে হিন্দু ধর্মীয় আবেগকে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা—সব মিলিয়ে বামেদের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে সংখ্যালঘু ভোটারদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। সাবরীমালা সোনাচুরির মামলায় সিপিআই(এম) নেতার নাম জড়ানোয় সেই ধারণা আরও জোরদার হয়। বহু শ্রমজীবী মুসলিম ভোটারের কাছে কংগ্রেস তুলনামূলকভাবে বেশি নির্ভরযোগ্য বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কিন্তু এই ‘সফট হিন্দুত্ব'এর কৌশলও বামেদের লাভ এনে দেয়নি। তিরুবনন্তপুরম, পালক্কাড ও ত্রিশূরে হিন্দু ভোটাররা এলডিএফের বদলে সরাসরি বিজেপির দিকে ঝুঁকেছেন। ফলে বাম শিবির পড়েছে দ্বিমুখী সংকটে- সংখ্যালঘুদের দূরে ঠেলে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটও ধরে রাখতে পারেনি তারা। বিশ্লেষকদের মতে, একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার পতাকা ও হিন্দু আবেগ তুষ্ট করার চেষ্টা রাজনৈতিকভাবে আত্মঘাতী হয়ে উঠেছে বামেদের পক্ষে।
জাতীয় রাজনীতির দিক থেকেও এই ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিরুবনন্তপুরম পুরনিগম বিজেপির কাছে কেরালায় প্রথম বড় প্রশাসনিক সাফল্য, যা রাজ্যজুড়ে পদ্ম শিবিরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বিস্তারের জন্য বড় অস্ত্র। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এনডিএ ইতিমধ্যেই ১১টি বিধানসভা এলাকায় এগিয়ে ছিল। এবার সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বিজেপি প্রায় ৩০টি বিধানসভা কেন্দ্রে ত্রিমুখী লড়াইয়ের শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকালে, স্থানীয় নির্বাচনের ফল ইউডিএফকে স্পষ্ট পছন্দ হিসেবে তুলে ধরছে। এই ধারা বজায় থাকলে ১৪০ আসনের বিধানসভায় কংগ্রেস জোট ৮০-৯০টি আসন পেতে পারে বলে ধারণা। এলডিএফ নেমে আসতে পারে ৪০-৬০ আসনে, যেখানে ২০২১ সালে তারা জিতেছিল ৯৯টি।
বামেদের জন্য এই সংকট অস্তিত্বগত। ষাটের দশক থেকে প্রায় অবিরাম কোনও না কোনও রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা সিপিআই(এম)-এর জন্য কেরালা শেষ বড় ভরসার কেন্দ্র। ২০২৬ সালে যদি এলডিএফ ক্ষমতা হারায়, তবে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার কমিউনিস্টদের হাতে কোনও রাজ্য সরকার থাকবে না। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে-ক্ষমতা হারানোর পর সংগঠন কত দ্রুত ভেঙে পড়তে পারে। যদিও কেরালার রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে ধারাবাহিকভাবেই সরকার বদল হওয়াই রাজ্যের স্বাভাবিক ঘটনা।
দ্যা ওয়্যার-এর বিশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, আত্মসমালোচনা ও আদর্শগত স্পষ্ট অবস্থান ছাড়া বামেদের ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন। কেরালার এই রাজনৈতিক রূপান্তর শুধু রাজ্যের নয়, গোটা ভারতের বাম, কংগ্রেস ও বিজেপি রাজনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশ করছে। লাল পতাকা এখনও উড়ছে, কিন্তু বাতাস যে দিক বদলেছে- তা আর অস্বীকার করার উপায় নেই।
