আজকাল ওয়েবডেস্ক: ভারতের শ্রম আইন কাঠামোয় স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এল শুক্রবার। কেন্দ্রীয় সরকার দেশের শ্রম ব্যবস্থাকে আধুনিক ও সমন্বিত করতে একইসঙ্গে চারটি নতুন শ্রম কোড কার্যকর করল—মজুরি কোড, শিল্প সম্পর্ক কোড, সামাজিক সুরক্ষা কোড এবং পেশাগত সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য কোড। এর ফলে বহু দশক ধরে চলা মোট ২৯টি পুরনো শ্রম আইন বাতিল হয়ে গেল এবং ভারতের শ্রম জগতে এক ঐতিহাসিক রূপান্তরের সূচনা হল।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, এতদিন পর্যন্ত শ্রম ক্ষেত্রের আইনগুলি বিভিন্ন সময়ে আলাদা আলাদা পরিস্থিতিতে তৈরি হওয়ায় বহু বিধানই ছড়ানো-ছিটানো ছিল। অনেক আইন ছিল প্রাক-স্বাধীনতা বা স্বাধীনতার অল্প কিছু পরে তৈরি—যা বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই ছিল না। দেশের অর্থনীতি গত এক দশকে দ্রুত আনুষ্ঠানিকীকরণের পথে এগিয়েছে, বেড়েছে গিগ অর্থনীতি, প্ল্যাটফর্ম জব, আইটি-আইটিএস, ডিজিটাল মিডিয়া, ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প এবং সংগঠিত-অসংগঠিত শ্রমের বৈচিত্র্য। এই পরিস্থিতিতে পুরনো আইনগুলির জটিলতা ও অস্পষ্টতা শ্রমিক ও নিয়োগকর্তা—উভয়ের ক্ষেত্রেই সমস্যার সৃষ্টি করছিল। নতুন শ্রম কোড সেই সব ফাঁক পূরণ করতে এসেছে।
নতুন কাঠামোয় একটি বড় পরিবর্তন হয়েছে সামাজিক সুরক্ষা ক্ষেত্রের বিস্তার। গিগ কর্মী, প্ল্যাটফর্ম কর্মী, চুক্তিভিত্তিক কর্মী, স্থির-মেয়াদি কর্মী, নির্মাণ শ্রমিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের শ্রমিক, খনি ও বন্দর শ্রমিক, প্ল্যান্টেশন কর্মী, বিড়ি শ্রমিক—সবাইকে প্রথমবার এক বিস্তৃত সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা হয়েছে। স্থির-মেয়াদি কর্মীদের এক বছরের চাকরির পর থেকেই গ্র্যাচুইটির সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা আগে ছিল না। বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক বার্ষিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিধানও শ্রমিকদের নিরাপত্তা বাড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে।
নারী কর্মীদের জন্যও এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। এখন থেকে সকল ক্ষেত্রে রাতে কাজ করার অনুমতি দেওয়া যাবে, তবে সেক্ষেত্রে কর্মীর সম্মতি, নিরাপত্তা, যাতায়াত এবং পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক। একইসঙ্গে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ মজুরি কাঠামো নিশ্চিত করা হয়েছে—নারী, পুরুষ বা তৃতীয় লিঙ্গ, কোনো ব্যক্তির মজুরিতে বৈষম্য করা যাবে না। জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে যে দেশের কোনো শ্রমিকই সরকারি নির্ধারিত সীমার নিচে বেতন পাবে না।
নতুন কোডে শ্রম সংক্রান্ত প্রশাসনিক জটিলতা কমাতে ‘সিঙ্গল রেজিস্ট্রেশন’ এবং ‘সিঙ্গল রিটার্ন’ পদ্ধতি চালু হয়েছে। ফলে কোম্পানি ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলিকে একাধিক ফর্ম, নথি ও আলাদা আলাদা কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট জমা দিতে হবে না। পুরনো ‘ইন্সপেক্টর রাজ’ ধারণা পরিবর্তন করে নতুন পদ্ধতিতে নিযুক্ত হওয়া ‘ইন্সপেক্টর-কাম-ফ্যাসিলিটেটর’ মূলত নির্দেশনা, পরামর্শ ও সহযোগিতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলিকে আইন মানতে সাহায্য করবে, সরাসরি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয়।
ডিজিটাল মিডিয়া, অডিও-ভিজুয়াল প্রোডাকশন, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, OTT প্ল্যাটফর্মসহ বহু নতুন পেশাজগত প্রথমবার সুনির্দিষ্ট আইনি স্বীকৃতি পেল। এই ক্ষেত্রের কর্মীদের এখন থেকে নিয়োগপত্র, বেতন কাঠামো, কাজের ধরন, ছুটি ও অধিকারগুলি স্পষ্টভাবে লিখিত আকারে পাওয়ার অধিকার থাকবে।
সরকার জানিয়েছে, শ্রম কোডগুলি বহু পর্যায়ের আলোচনা, বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ও রাষ্ট্রীয়-আঞ্চলিক সংলাপের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে। বিস্তারিত নিয়মাবলি তৈরির সময় আরও জনমত গ্রহণ করা হবে। পরিবর্তনের এই সময়ে প্রয়োজন হলে পুরনো কিছু আইন আংশিকভাবে কার্যকর রাখা হতে পারে।
২০১৫ সালে ভারতের শ্রমশক্তির মাত্র ১৯ শতাংশ সামাজিক সুরক্ষার আওতায় ছিল। ২০২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪ শতাংশেরও বেশি। সরকারের দাবি, নতুন চার শ্রম কোড এই অগ্রগতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং ভারতের শ্রম বাজারকে করবে আরও আধুনিক, স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক।
