আজকাল ওয়েবডেস্ক: উত্তরাখণ্ডে দুর্নীতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন করার জন্য পরিচিত সাংবাদিক রাজীব প্রতাপের মৃত্যু ঘিরে রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে। ৩৬ বছর বয়সী রাজীব প্রতাপ, যিনি Delhi Uttarakhand Live নামে একটি ইউটিউব সংবাদ চ্যানেল পরিচালনা করতেন, তাঁর দেহ ২৮ সেপ্টেম্বর ভগীরথী নদী থেকে উদ্ধার হয়।
রাজীব প্রতাপ শেষবার স্ত্রীকে ফোনে কথা বলেন ১৯ সেপ্টেম্বর। সেই দিনই তাঁর গাড়ি ভগীরথী নদীর ধারে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার হয়। এরপর টানা নয় দিন নিখোঁজ থাকার পর, জোশিয়ারা জলবিদ্যুৎ বাঁধের কাছে তাঁর দেহ ভেসে ওঠে।
পুলিশের প্রাথমিক দাবি ছিল, দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু পরিবার এ দাবি মানতে নারাজ। রাজীব প্রতাপের স্ত্রী মুসকান বলেন,“হাসপাতাল আর স্কুল নিয়ে করা ভিডিও আপলোড করার পর থেকেই ওকে ফোনে নানা হুমকি আসছিল। ও আমাকে বলেছিল, প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। ১৯ তারিখ রাত ১১টা ৫০ মিনিটে আমি শেষবার ওকে মেসেজ করি, কিন্তু আর ডেলিভার হয়নি। ওকে কেউ অপহরণ করেছে। স্রেফ দুর্ঘটনায় মৃত্যু নয়।”
রাজীব প্রতাপের অন্যতম আলোচিত প্রতিবেদন ছিল উত্তরাখণ্ডের এক সরকারি হাসপাতালে কীভাবে প্রকাশ্যে মদ্যপান করা হচ্ছিল তা নিয়ে। তিনি রাজ্যের একাধিক দুর্নীতির ঘটনাও তাঁর প্ল্যাটফর্মে তুলে ধরেছিলেন। পরিবার ও সহকর্মীদের অভিযোগ, এই কারণেই তাঁকে নিশানা করা হয়।
আরও পড়ুন: বিজেপি মুখপাত্রের ‘মারণ হুমকি’ ঘিরে তীব্র বিতর্ক, কংগ্রেসের চিঠি অমিত শাহকে
উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি সাংবাদিকের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন এবং পূর্ণাঙ্গ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে সাংবাদিক মহল দাবি করছে, শুধু প্রশাসনিক প্রতিশ্রুতিতে থেমে গেলে চলবে না, ঘটনার প্রকৃত সত্য সামনে আনতে হবে। ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অফ জার্নালিস্টস, দিল্লি ইউনিয়ন অফ জার্নালিস্টস এবং কেরালা ইউনিয়ন অফ ওয়ার্কিং জার্নালিস্টস (দিল্লি ইউনিট) জরুরি ভিত্তিতে তদন্তের দাবি তুলেছে।
কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস-এর ভারতীয় প্রতিনিধি কুনাল মজুমদার বলেন, “শুধুমাত্র গাড়ি দুর্ঘটনার গল্প বলে এ মামলা শেষ করা যাবে না। পরিবার যে অভিযোগ করেছে, সেটিও গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা প্রয়োজন। সাংবাদিকদের হুমকি যারা দিচ্ছে তাদের শাস্তি পেতেই হবে।” ভারতের প্রখ্যাত গণমাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউশন অফ মাস কমিউনিকেশন-ও এক্স-এ লিখেছে, “মৃত্যু রহস্যজনক। আমরা চাই পুলিশ স্বচ্ছভাবে তদন্ত করে সামনে আসুক।”
এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গত কয়েক বছরে একাধিক সাংবাদিক দুর্নীতি বা মাফিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করার পর রহস্যজনকভাবে নিহত হয়েছেন—ফেব্রুয়ারি ২০২৩: মহারাষ্ট্রে রিয়েল এস্টেট লবির গাড়িচাপায় নিহত হন অনুসন্ধানী সাংবাদিক শশিকান্ত ওয়ারিশে। মে ২০২২: বিহারে বালু মাফিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবেদনকারী সাংবাদিক সুভাষ কুমার মহতোকে বাড়ির বাইরে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০২৪ সালের শুরুতে: ছত্তীসগড়ে নিখোঁজ সাংবাদিক মুক্তেশ চন্দ্রকারের দেহ এক ঠিকাদারের বাড়ির সেপটিক ট্যাঙ্ক থেকে উদ্ধার হয়।
সংবাদমাধ্যম পর্যবেক্ষক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস-এর সূচকে ভারত বর্তমানে ১৮১টি দেশের মধ্যে ১৫১তম স্থানে রয়েছে। গত আগস্টে সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় সরকার জানায়, “ভারতে একটি প্রাণবন্ত সংবাদমাধ্যম ব্যবস্থা রয়েছে, যা বিদেশি সংস্থার স্বীকৃতি প্রয়োজন করে না।”
কিন্তু সাংবাদিক মহলের প্রশ্ন—প্রশাসন যদি সত্যিই স্বচ্ছ হয়, তবে কেন একের পর এক অনুসন্ধানী সাংবাদিকের মৃত্যু রহস্যে ঢাকা পড়ছে?
রাজীব প্রতাপের মৃত্যুর পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবিতে ইতিমধ্যেই দিল্লি থেকে দেরাদুন পর্যন্ত সাংবাদিক সংগঠনগুলো সরব হয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীদের মতে, এ মামলার বিচার শুধু একজনের জন্য নয়—ভারতের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই হিসেবেই দেখা উচিত।
