গোপাল সাহা

দেশবাসীর মনে ২২ এপ্রিল দিনটি গভীর ছাপ রেখে গিয়েছে। ওই অভিশপ্ত দিনে কাশ্মীরের পহেলগাঁওতে নির্মমভাবে হত্যা হয়েছিল একাধিক ভারতীয় পর্যটককে। জঙ্গি কার্যকলাপে মদতদাতা পাকিস্তানের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ভারতের লড়াই শুরু হয় সেই সময়। জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ-ই-মহম্মদের এই ধরনের হামলার প্রতিবাদে ভারতীয় সেনা অপারেশন সিঁদুর অভিযান চালায় এবং পাকিস্তানে একের পর এক জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করে। কেন্দ্র দাবি করেছিল, আর কোনও সমস্যা বা হামলার ঘটনা দেশবাসীকে দেখতে হবে না। কিন্তু গত ১০ নভেম্বর সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ওই দিন ৬টা ৫৫ মিনিটে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে রক্তাক্ত মাংসের টুকরোগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল, চোখের নিমিষে বহু প্রাণ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। শেষ তথ্য অনুযায়ী, ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত প্রায় ২০ জন। মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে খবর। 

এরপরে জোরকদমে তদন্ত শুরু করেছে কেন্দ্রীয় সংস্থা এনআইএ। যদিও তথ্য বলছে, কেন্দ্রের ইন্টালিজেন্সের দুর্বলতার কারণেই এই ঘটনা আবারও দেখতে হল দেশবাসীকে। তদন্ত শুরু হতেই পাঁচ জন ডাক্তারকে গ্রেপ্তার হয় যাঁদের মধ্যে একজন মহিলা। নাম ডা. শাহিন সইদ। জইশ-প্রধান মাসুদ আজহারের ভাই এই চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণ করত বলে সূত্রের খবর। মাসুদের ভাই মুজাম্মিল এই ডাক্তারদের জঙ্গি মডিউলের মূল হোতা। এটি ‘ফিদায়েঁ’ মডিউল। 

দিল্লি বিস্ফোরণের পূর্বে, গুজরাটের সন্ত্রাসদমন শাখা (এটিএস) গত ৮ নভেম্বর তিন জনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মধ্যে একজন ছিল ডা. আহমেদে মহিউদ্দিন সায়েদ। এমবিবিএস পাস করার পরেও আহমেদাবাদে একটি ফাস্টফুডের দোকান চালাত সায়েদ। এটিএসের অভিযোগ সেই দোকানের আড়ালেই ভয়ঙ্কর বিষাক্ত জৈব অস্ত্র বা রাসায়নিক অস্ত্র ‘রাইসিন’ বানানোর কাজ চলত। সায়েদ চীন থেকে ডাক্তারি পাস করে দেশে ফিরে অনলাইনে ডাক্তারি করত। নিজের কোনও চেম্বার ছিল না, কোথাও প্র্যাকটিসও করত না। সূত্রের খবর, ধৃতদের বিষাক্ত রাইসিন দিয়ে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে মারার পরিকল্পনা ছিল। সায়েদ ও তাঁর দলবল আহমেদাবাদ, দিল্লি ও লখনউয়ের বেশ কিছু এলাকা রেইকি করেছিল।

এখন প্রশ্ন উঠছে, রাইসিন কী এমন বিষাক্ত জিনিস যা দিয়ে মানুষকে প্রাণে মেরে দেওয়া যাবে? রাইসিন হল ভ্যারেন্ডার বিজ বা রেড়ির তেল উৎপাদনকারী বীজ। যা খুব বিষাক্ত। 

আরজি কর হাসপাতালের মেডিকেল সুপার ভাইস প্রিন্সিপাল (এমএসভিপি) সপ্তর্ষি চ্যাটার্জি। নিজস্ব চিত্র।

এর ব্যবহার সম্পর্কে সরাসরি আজকাল ডট ইন-এর সঙ্গে কথা বলেন আরজি কর হাসপাতালের মেডিকেল সুপার ভাইস প্রিন্সিপাল (এমএসভিপি) চিকিৎসক সপ্তর্ষি চ্যাটার্জি। তিনি বলেন, “এই বীজ এক ভয়ঙ্কর বিষাক্ত জিনিস, যা মানুষের শরীরে প্রবেশ করাতে পারলে অর্থাৎ রক্তে মিশলে তিন থেকে চার দিনের মধ্যে ভয়ঙ্কর ভাবে মৃত্যু ঘটবে। রাইসিন দিয়ে রাসায়নিক বা জৈব অস্ত্র প্রস্তুত করা যেতে পারে যা মানবসমাজের জন্য ভয়ঙ্কর। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার, এই ধরনের বিষক্রিয়ায় মানুষের মৃত্যু হলে বোঝা  যাবে না যে কোনও বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে বা কীভাবে মৃত্যু হয়েছে। একমাত্র ময়নাতদন্ত করলেই ধরা পরতে পারে। কিন্তু সাধারণভাবে এর প্রয়োগ বোঝা খুব মুশকিল।” তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের জৈব অস্ত্রের ব্যবহার তিলের থেকেও ছোট, যা খালি চোখে দেখা যাবে না এমন ভাবেই এর প্রয়োগ হয়ে থাকে। এই বিষের প্রয়োগ ইনজেকশনের মাধ্যমে হয়ে থাকে কিংবা খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাইয়ে দিলে মৃত্যু অবধারিত। তবে বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে গণহত্যা খুব কঠিন এবং সেটা বাস্তবে রূপায়িত করাও খুব কঠিন। কিন্তু এ ধরণের ভয়ঙ্কর প্রক্রিয়া সচরাচর শোনা যায় না। তবে বুলগেরিয়ান ‘আনসলভ মিস্ট্রি’ হিসেবে এক সাংবাদিকের হত্যার তথ্য থেকে এর প্রয়োগ জানা গিয়েছে ১৯৭৮ সালের একটি ঘটনা থেকে।

রেড়ির বা ভ্যারেন্ডার বীজের গুড়োর মধ্যে থাকে এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ যাকে রাইসিন বলা হয়। এই যে গাছ তার বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘রিসিনাস কামিউনিস’। সেখান থেকেই নাম এসেছে রাইসিন। 

এবার এই রাইসিন মানুষের শরীরে গেলে এক ধরনের জ্বর হয়, যার ফলে বমি, রক্তচাপের তারতম্য, ডায়রিয়া এবং শ্বাসকষ্ট হতে শুরু করে। আর এই ভাবেই তিন থেকে চার দিন পর সেই ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। চিকিৎসকদের মতে, রেড়ির বীজে থাকা রাইসিন মানুষের শরীরে গিয়ে  রেস্পিরেটরি সিস্টেমকে নষ্ট করে দেয় এবং যার ফলে মানুষের মৃত্যু হয়।

উল্লেখযোগ্য বিষয়, এক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিকে বাঁচাতে গেলে শরীর থেকে ওই বিষ বার করে ফলতে হবে সম্পূর্ণভাবে। নইলে তাঁকে বাঁচানো এক প্রকার অসম্ভব। এর কোনও অ্যান্টিডোট নেই বলেই জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।