আজকাল ওয়েবডেস্ক: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) সাম্প্রতিক রিপোর্টে ভারতের জাতীয় হিসাব-নিকাশকে ঘিরে নতুন করে সন্দেহ এবং বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ২৬ নভেম্বর প্রকাশিত ২০২৫ সালের Article IV Consultation Report–এ ভারতের জাতীয় হিসাবভিত্তিক তথ্যকে IMF ‘সি’ গ্রেড দিয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারত যে তথ্য IMF–কে সরবরাহ করেছে, তাতে একাধিক ত্রুটি রয়েছে এবং তা সংস্থার নজরদারি বা সার্ভেল্যান্স প্রক্রিয়াকে কার্যত বাধাগ্রস্ত করছে। IMF–এর দায়িত্ব সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যান গ্রহণ করা, কিন্তু এই মূল্যায়ন স্পষ্টতই জানাচ্ছে—পরিসংখ্যান নির্ভরযোগ্য নয়। সহজ ভাষায়, ‘সি’ গ্রেড মানে হল অফিসিয়াল ডেটা মানদণ্ডে খাপ খাচ্ছে না—অর্থাৎ সাম্প্রতিক প্রকাশিত ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের ৮.২ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি নিয়ে বাস্তব সন্দেহ থেকেই যায়।

ভারতের অর্থনীতি সত্যিই এত দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিভিন্ন সূচক। যেসব বিনিয়োগ প্রকল্প বাতিল হয়েছে কিংবা মাঝপথে থেমে গেছে এবং নেট এফডিআই মাইনাসে নেমে এসেছে—এসবই কোনও শক্তিশালী ও জোরদার অর্থনৈতিক বিকাশের চিত্র তুলে ধরে না। IMF রিপোর্ট বলছে, ভারতের জিডিপি অনুমান বহু ক্ষেত্রেই পুরনো ডেটা ও দুর্বল পদ্ধতির উপর নির্ভর করে তৈরি করা হচ্ছে। ২০১১–১২ সালের বেস ইয়ার এখনও ব্যবহার করা হচ্ছে, যা বর্তমান অর্থনীতির কাঠামোর সঙ্গে আর সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিশেষ করে তথ্য না থাকার কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত (informal sector) যেভাবে অর্থনীতির বাইরে পড়ে যাচ্ছে, তা জিডিপির প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করছে। এছাড়া ২০১৯ সালের পর থেকে রাজ্য সরকার এবং স্থানীয় সংস্থার সম্মিলিত আর্থিক তথ্যও নেই, ফলে জাতীয় হিসাব আরও অস্পষ্ট হয়ে উঠছে।

এই সমস্যাগুলোর কথা গত কয়েক বছর ধরে বহু অর্থনীতিবিদই তুলে ধরেছেন। নোটবন্দি, ২০১৭ সালের জিএসটি বাস্তবায়নের গোলযোগ, ২০১৮-র এনবিএফসি সংকট এবং ২০২০-র মহামারী—একটি পর একটি ধাক্কা ভারতের পরিসংখ্যান ব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করে দেয়। IMF যদিও সরাসরি উল্লেখ করেনি, বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১১–১২ বেস ইয়ারে তৈরি নতুন জিডিপি সিরিজ নিয়েও বড়সড় প্রশ্ন রয়েছে। এই সিরিজ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয় NDA সরকারের আমলে, যদিও প্রস্তুতির কাজ শুরু হয়েছিল UPA–র সময়ে। সরকারি কমিটি পূর্বের ডেটার ভিত্তিতে একটি হিসাব তৈরি করলেও তা প্রত্যাখ্যান করা হয় কারণ সেই হিসাব অনুযায়ী UPA আমলে বৃদ্ধির হার বেশি ছিল। পরে নীতি আয়োগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, যদিও এই ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা প্রশ্ন তোলেন। নতুন সিরিজ NDA আমলে  উচ্চ বৃদ্ধির হার দেখায়, যা রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক। কিন্তু প্রাক্তন প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যম তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, জিডিপি টালমাটাল গণনায় অন্তত ২.৫ শতাংশ বা তার বেশি অতিরিক্ত যোগ হয়েছে।

তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আরও সমস্যা তৈরি হয় যখন MCA21 ডাটাবেসে থাকা ১৮ লক্ষ কোম্পানির মধ্যে ৩ লক্ষ ‘শেল কোম্পানি’ বাদ দেওয়া হয়, অথচ জিডিপি অনুমানে তার কোনও প্রভাব দেখা যায়নি। পরে তদন্তে দেখা যায়, ৩৫ শতাংশ কোম্পানি তাদের উল্লিখিত ঠিকানাতেই অস্তিত্বহীন—অর্থাৎ সেগুলো সম্ভবত ভুয়ো ডেটা ব্যবহার করছিল। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত এবং কালো অর্থনীতির বিস্তীর্ণ অংশও সরকারি গণনায় ধরা পড়ে না—ফলে সরকারি জিডিপি পরিসংখ্যান এবং বাস্তব অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে ব্যবধান আরও বাড়ছে।

সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে 'অস্বস্তিকর' ডেটা প্রকাশ বন্ধ বা বিলম্ব করছে। যেমন, ২০১৭–১৮ সালের উপভোক্তা ব্যয় সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়নি। ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে বেকারত্বের ডেটাও গোপন রাখা হয় কারণ সেটি ছিল গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের পরিবর্তিত ডেটাও প্রশ্নের মুখে, কারণ সেখানে তুলনা করার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে ২০১৫–১৬ বনাম ২০১৯–২১, যার মধ্যে রয়েছে মহামারীর বছর—যে সময়ে আয় কমেছে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অ্যাক্সেসও পিছিয়েছে। অথচ দাবি করা হচ্ছে দারিদ্র্য কমেছে।

পরিসংখ্যান ব্যবস্থার অন্য বড় সমস্যা হল—নমুনা সংগ্রহ এখনও ২০১১ সালের আদমসুমারির উপর নির্ভর করে। ২০২১ সালের Census না হওয়ায় ভারতের ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তন সরকারি ডেটায় প্রতিফলিত নয়। একইভাবে CPI বা মূল্যসূচকও ২০১১–১২ সালের খরচের ধরণ অনুযায়ী তৈরি, অথচ বাজারের পণ্য, সেবা, আয়বণ্টন ও সমাজের ব্যয় কাঠামো বহু বদলেছে।

IMF আরও বলছে, উৎপাদন পদ্ধতিতে মাপা জিডিপি এবং ব্যয়ভিত্তিক জিডিপির মধ্যে যে হিসাবগত মিল থাকার কথা, তা নেই। এই পার্থক্য নোটবন্দির পর দ্রুত বেড়ে ওঠে এবং এখন তা অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করছে—কখনও পজিটিভ, কখনও নেগেটিভ—যা ডেটার অস্থিরতা এবং অবিশ্বস্ততা নির্দেশ করে। ত্রৈমাসিক জিডিপিতে অনানুষ্ঠানিক খাতের তথ্য না থাকায় সংগঠিত খাতকে 'প্রক্সি' হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, অথচ ভারতের বাস্তবতা হল—সংগঠিত খাত বাড়ছে এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত সংকুচিত হচ্ছে। ফলে বৃদ্ধির হিসাব কৃত্রিমভাবে ফুলেফেঁপে  উঠছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, IMF–এর এই রিপোর্ট শুধু পরিসংখ্যানগত ত্রুটি নয়, নীতিনির্ধারণের সংকটও সামনে আনছে। কারণ সঠিক অর্থনৈতিক নকশা তৈরি করা সম্ভব নয় ভুল বা বিকৃত ডেটার উপর নির্ভর করে। সরকারের সমর্থকেরা হয়ত এই বাস্তবতা স্বীকার করতে চাইছেন না, কিন্তু সত্য হল—বিশ্বাসযোগ্য ডেটা ছাড়া কার্যকর নীতি, দায়বদ্ধ প্রশাসন বা সুস্থ অর্থনীতি—কোনোটাই সম্ভব নয়।


সূত্র: ন্যাশনাল হেরাল্ড