আজকাল ওয়েবডেস্ক: আরাবলী পাহাড়ের ‘নতুন সংজ্ঞা’ দেশজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু দিল্লির ‘সবুজ ফুসফুস’ হিসেবে পরিচিত এই পাহাড়শ্রেণিকে ভিতর থেকে ফাঁপা করে ফেলার প্রচেষ্টা কয়েক দশক ধরেই চলছে। আরাবলির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হরিয়ানায় পড়েছে। বছরের পর বছর ধরে একের পর এক সরকার বিশাল এলাকা নির্মাতা ও কর্পোরেট সংস্থাগুলির হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এর নেপথ্যে রয়েছে রাজনীতিবিদ, আমলা এবং আবাসন ব্যবসায়ীদের একটি অশুভ চক্র।
প্রকৃতপক্ষে, জলবায়ু কর্মীদের হস্তক্ষেপ এবং আদালতের আদেশ না থাকলে আজ দিল্লি ও ফরিদাবাদ থেকে গুরুগ্রাম পর্যন্ত আরাবলী পর্বতমালা উঁচু বহুতলে ছেয়ে যেত। হরিয়ানায় যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, সরকারগুলি আরাবলীকে বনভূমির আইনি সংজ্ঞা থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
২০১৭ সালে হরিয়ানা সরকার এনসিআর প্ল্যানিং বোর্ডের কাছে ফরিদাবাদের ১৭,০০০ একর জমিকে ‘বনভূমি’ তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। ডিসেম্বরে বোর্ড এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জানায় যে, আরাবলী বনভূমির সীমানা নির্ধারণ তাদের সিদ্ধান্ত এবং পরিবেশ মন্ত্রকের জারি করা বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতেই করা হবে।
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রের প্রস্তাবিত একটি নতুন সংজ্ঞা গ্রহণ করার পর আরাবলী আলোচনায় রয়েছে। নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী, স্থানীয় ভূখণ্ড থেকে ১০০ মিটার উঁচু পাহাড়গুলিকেই কেবল ‘আরাবলী পাহাড়’ হিসেবে গণ্য করা হবে। এর ফলে ওই এলাকার ৯০ শতাংশ জুড়ে ব্যাপক খনিজ উত্তোলনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদিও কেন্দ্র এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। অতীতে, হরিয়ানা সরকার কোনও তদারকি ছাড়াই আরাবলী অঞ্চলের জমি বিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।
আরাবলীর জমি ডিআরডিও-র কাছে বিক্রি
২০০৪ সালে ডিআরডিও একটি ইউনিট নির্মাণের জন্য আরাবলীর ৭০০ একর জমি কেনার প্রক্রিয়া শুরু করে। পরে ২০০৫ সালের আগস্টে তারা তাদের জমির চাহিদা বাড়িয়ে ১,১০০ একর করে। তবে, সেই বছরের নভেম্বরে বন সংরক্ষক ডিআরডিও-কে জানা যে এটি পাঞ্জাব ভূমি সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ‘বনভূমি’ এবং এখানে অন্যান্য কার্যকলাপের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে।
২০০৭ সালের মে মাসে, ডিআরডিও তাদের জমির চাহিদা কমিয়ে ৪০৭ একর করে। একই বছর ফরিদাবাদ পুরসভা জমি বরাদ্দের অনুমোদন দেয়। বন বিভাগের ছাড়পত্র বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও, ডিআরডিও ২০০৮ সালের এপ্রিলে তিনটি কিস্তিতে হরিয়ানা সরকারকে ৭৩.২৬ কোটি টাকা প্রদান করে এবং জমির দখল নেয়।
সুপ্রিম কোর্ট-নিযুক্ত কেন্দ্রীয় ক্ষমতাপ্রাপ্ত কমিটি (সিইসি) নির্মাণের অনুমতি দেয়নি। পরে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) এই ‘অবিবেচনামূলক’ সিদ্ধান্তের জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রককে তিরস্কার করে।
হুডা সরকারের বিতর্কিত পরিকল্পনা
ফরিদাবাদ এবং গুরুগ্রামের মাঝে আরাবলী পাহাড়শ্রেণির কোলে অবস্থিত একটি মনোরম গ্রাম মাঙ্গার। ২০০৭ সালের জুন মাসে তৎকালীন ভূপিন্দর হুডার নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার একটি ডাচ কোম্পানিকে মাঙ্গারে ৫০০ একর জমির উপর একটি টেকনোলজি পার্ক নির্মাণের অনুমতি দেওয়ার পরিকল্পনা অনুমোদন করে। তবে পরিবেশগত উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে কেন্দ্র সরকার প্রকল্পটি আটকে দেয়।
তা সত্ত্বেও, হুডা সরকার ২০১২ সালে ‘মাঙ্গার উন্নয়ন পরিকল্পনা ২০৩১’ তৈরি করে। এই পরিকল্পনাটি মাঙ্গারের আশেপাশের ২৩টি গ্রাম জুড়ে ১০,৪২৬ হেক্টর এলাকাকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। পরিবেশকর্মীদের প্রতিবাদ এবং আরাবলীর অপূরণীয় ক্ষতি হবে বলে এনসিআর প্ল্যানিং বোর্ড এই পরিকল্পনায় অনুমোদন দিতে অস্বীকার করে। শুধু কংগ্রেসই নয়, বিজেপি সরকারও আরাবলী পাহাড়শ্রেণিতে বিতর্কিত পরিবর্তনের পরিকল্পনা করেছিল।
সুপ্রিম কোর্টে সংশোধনী স্থগিত
মনোহর লাল খট্টর সরকারের অধীনে, হরিয়ানা বিধানসভা ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পাঞ্জাব ভূমি সংরক্ষণ (হরিয়ানা সংশোধনী) বিল (পিএলপিএ) পাস করেছিল। এই পরিবর্তনের ফলে আরাবলী পর্বতমালার প্রায় ৬০,০০০ একর জমি আবাসন ও খনিজ উত্তোলনের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যেত। তবে সুপ্রিম কোর্ট এতে বাধা দেয় এবং সংশোধনীটি স্থগিত করে দেয়।
এই সংশোধনীর মাধ্যমে আরাবলীর বিশাল এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকার মর্যাদা থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। যার ফলে অবাধ নির্মাণ ও খনিজ উত্তোলনের পথ খুলে যেত। সুপ্রিম কোর্ট হরিয়ানা সরকারের তীব্র সমালোচনা করে বলেছিল যে, তারা ‘বন ধ্বংস করতে পারে না’। আদালত স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে, পিএলপিএ-এর আওতাভুক্ত জমিকে ‘বনভূমি’ হিসেবেই গণ্য করতে হবে।
এভাবে, বছরের পর বছর ধরে এই সময়োপযোগী হস্তক্ষেপগুলি এখন পর্যন্ত আরাবলীকে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ এবং লাগামহীন খনিজ উত্তোলনের হাত থেকে রক্ষা করেছে।
