দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে মায়া সভ্যতার ক্যালেন্ডারে ব্যবহৃত রহস্যময় ৮১৯ দিনের চক্র গবেষকদের জন্য এক জটিল ধাঁধা হয়ে ছিল। এই নির্দিষ্ট দিনের হিসাবটি মায়া শিলালিপি ও লেখায় বারবার দেখা গেলেও, তা ঠিক কী বোঝাতে ব্যবহৃত হত—তার কোনও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা এতদিন পাওয়া যায়নি। তবে এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুলেন ইউনিভার্সিটি-র গবেষকদের এক নতুন বিশ্লেষণে এই রহস্যের বড় অংশ উন্মোচিত হয়েছে। তাঁদের মতে, এই ৮১৯ দিনের চক্র আসলে খালি চোখে দেখা যায় এমন সব গ্রহের গতিবিধি অনুসরণ করে।
2
10
আগের গবেষণাগুলিতে যেখানে মাত্র কয়েকটি ৮১৯ দিনের ধাপকে আলাদা করে দেখা হত, সেখানে নতুন এই গবেষণায় বিষয়টিকে অনেক বড় সময়সীমার মধ্যে বিচার করা হয়েছে। প্রায় ৪৫ বছরের দীর্ঘ এক চক্রে এই ৮১৯ দিনের হিসাবকে বসিয়ে দেখলে দেখা যায়, তখন বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি—এই পাঁচটি দৃশ্যমান গ্রহই পরিষ্কারভাবে মিলে যায়।
3
10
মায়া সভ্যতার ক্লাসিক যুগের একাধিক শহরের শিলালিপিতে এই ৮১৯ দিনের গণনার উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন পণ্ডিতরা এই চক্রকে চারটি রং ও চারটি দিকের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন, যেখানে প্রতিটি পর্যায়ের মাঝে ছিল ৮১৯ দিনের ব্যবধান। কিন্তু শুধুমাত্র চারটি পর্যায়ের মধ্যে গ্রহগুলির গতিপথ মেলাতে গিয়ে গবেষকরা বারবার ব্যর্থ হয়েছিলেন।
4
10
এই নতুন গবেষণার নেতৃত্ব দেন জন এইচ লিন্ডেন, যিনি মায়া লিপিবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে প্রশিক্ষিত একজন স্বাধীন গবেষক। নৃতত্ত্ববিদ ভিক্টোরিয়া আর ব্রিকার-এর সঙ্গে যৌথভাবে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে প্রাচীন মায়া লেখকরা জটিল ক্যালেন্ডারের মধ্যে গ্রহগত সময়কে এনকোড করেছিলেন।
5
10
তাঁদের মতে, আগের চার-পর্যায়ের মডেলটি খুবই ছোট ছিল। সেই কারণে সব গ্রহের চক্র সেখানে ধরা পড়েনি। কিন্তু যখন ৮১৯ দিনের গণনাকে ২০টি পূর্ণ চক্রে বিস্তৃত করা হয়, তখন সমাধানটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ৮১৯ × ২০ = ১৬,৩৮০ দিন, যা একাধিক গ্রহের পর্যায়িক গতিকে একসঙ্গে বেঁধে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট বড় সময়কাল।
6
10
জ্যোতির্বিজ্ঞানে কোনও গ্রহ আবার আকাশে একই অবস্থানে ফিরে আসতে যে সময় নেয়, তাকে বলা হয় সাইনোডিক পিরিয়ড। বুধের ক্ষেত্রে তা প্রায় ১১৭ দিন, শুক্রের ৫৮৪ দিন, মঙ্গলের ৭৮০ দিন, বৃহস্পতির প্রায় ৩৯৯ দিন এবং শনির প্রায় ৩৭৮ দিন। এককভাবে ৮১৯ দিন এই কোনও চক্রের সঙ্গেই পুরোপুরি মেলে না।
7
10
কিন্তু দীর্ঘ সুপার-চক্রে দেখলে দেখা যায়—বুধ প্রতি ৮১৯ দিনেই পুনরাবৃত্ত হয়। শুক্র ৫টি চক্রের পরে আসে। শনি ৬টি চক্রের পর আসে। বৃহস্পতি ১৯টি চক্রের পর আসে। মঙ্গল ২০টি চক্রে আবার একই অবস্থানে ফিরে আসে।
8
10
গবেষকদের মতে, মায়া জ্যোতির্বিদরা আকাশকে আলাদা আলাদা গ্রহের সমষ্টি হিসেবে নয়, বরং এক সমন্বিত মহাজাগতিক ব্যবস্থা হিসেবে দেখতেন। এই চক্রটি আবার যুক্ত ছিল ত্জোলকিন নামে পরিচিত ২৬০ দিনের পবিত্র ক্যালেন্ডারের সঙ্গে। ত্জোলকিনের ৬৩টি চক্র শেষে দিনগুলো আবার ৮১৯ দিনের সুপার-চক্রের সূচনাবিন্দুর সঙ্গে মিলে যায়।
9
10
এই জটিল ক্যালেন্ডার গণনাই মায়া পুরোহিতদের ক্ষমতার ভিত্তি ছিল। গ্রহের অবস্থান আগে থেকে নির্ভুলভাবে জানার মাধ্যমে তাঁরা রাজকীয় আচার, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জন্য “শুভ মুহূর্ত” নির্বাচন করতে পারতেন। এইভাবে আকাশ, ধর্ম এবং রাজনীতি—সবকিছুই একসূত্রে বাঁধা ছিল মায়া সভ্যতায়।
10
10
এই নতুন ব্যাখ্যা প্রমাণ করে, প্রাচীন মায়ারা শুধু ধর্মীয় মানুষই ছিলেন না, বরং অসাধারণ গাণিতিক ও জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক দক্ষতার অধিকারীও ছিলেন।