উদ্দালক ভট্টাচার্য
মানুষের জীবনে কখনও কখনও এমন এক-একটা সময় আসে। যখন মানুষ শিল্পের মুখোমুখি দাঁড়ায়, কিন্তু ক্রমে সেই শিল্পের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁর মনে হয়, বুঝি নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন তিনি। বারাসত কাল্পিকের আননোন থটস তেমনই এক আয়না। আপনাকে এনে দাঁড় করাবে এক আশ্চর্য স্বচ্ছ জলরাশির সামনে, যেখানে আপনি দেখতে পাবেন নিজের প্রতিচ্ছবি, দেখবেন আর আপনার মনের মধ্যে ঝড় উঠবে। কারণ, আপনি মানতে বাধ্য হবেন, আপনিও জীবনের কোনও না কোনও স্তরে গিয়ে ওই নাটকের চরিত্রদের মতোই। ক্রমে আপনাকে গ্রাস করবে নৈঃশব্দ। সেখানে ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নগুলো নিয়ে আপনি অস্থির হয়ে উঠবেন ক্রমে। হ্যাঁ, এই নাটক আপনাকে অস্থির করে তুলবে।
বারাসত কাল্পিকের আননোন থটস একটি থিয়েটার কর্মশালা ভিত্তিক প্রযোজনা। গত ২৬ মার্চ, তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহে আনন্দপুর গুজবের নাট্য উৎসবের অংশ হিসাবে এটি অভিনীত হল। সেই সন্ধেয় এটিই ছিল শেষ নাটক। ৫০-৫৫ মিনিটের এই প্রযোজনা প্রথম থেকেই আপনাকে ধাক্কা দেবে। এমন এক ধাক্কা যা আপনার সামলাতে অনেকটা সময় লাগতে বাধ্য। চার্লস ডারউইনের যোগ্যতমের উদ্বর্তনের তত্ত্বের দিকে আলো ফেললে এক দার্শনিক প্রশ্ন আসে। কে যোগ্য? কী তার যোগ্যতার মাপকাঠি? কে ঠিক করবে কে যোগ্য়, যোগ্য নয়! কেবল শারীরিক ক্ষমতাই যোগ্যতার মাপকাঠি? সেই প্রশ্নটিই তুলে দিয়ে যায় এই নাটক। প্রশ্ন তোলে যোগ্যতা ও টিকে থাকার মধ্যেকার আপাত বিরোধমূলক অবস্থা নিয়ে। প্রশ্ন তোলে জীবনে হিংসার অমোঘ উপস্থিতি নিয়ে।
এই নাটক বাহুল্য বর্জিত। অন্ধকার চারকোনা ঘরে আলোর সামান্য ব্যবহারে এই নাটকের মায়া তৈরি করেছেন পরিচালক দেবব্রত ব্যানার্জি। এই নাটকের প্রত্যেকেই একরকমের মানুষ। তাঁদের মানুষ পরিচয়টা প্রথম থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। জাত-ধর্ম পাল্টালেও এদের মানুষ ও মানবিক প্রবৃত্তি একেবারেই পাল্টায় না। আসলে বেঁচে থাকতে গেলে অপরকে হত্যা করে বাঁচতে হবে। টিকে থাকার লড়াইয়ে ভাই, বন্ধু, মা-বোন বলে কেউ নেই। শেষ পর্যন্ত সংকটে নিজের জীবন বাঁচাতে, টিকে থাকতে গিয়ে যে কাউকে-যখন তখন ধ্বংস করে দিতে হতে পারে। মানুষের মগজকে শান্তি ও সম্পর্কের বদলে ধীরে ধীরে গ্রাস করবে ক্ষোভ, রাগ, সন্দেহ। অবশ্যম্ভাবী ভাবেই তা চালিত করবে মানুষের ডেস্টিনির কাছে। সেই ডেস্টিনি বা ভবিতব্য শেষ পর্যন্ত তাই হাতে অস্ত্র তুলে নিতে ইন্ধন জোগাবে শেক্সপিয়ারের ইয়াগোর মতো। কানের কাছে ফিসফিস করবে সারাক্ষণ।
এই নাটকে সামগ্রিক ভাবে কাজ করেছেন দেবব্রত। নাটকের পরিচালক যেমন তিনি, তেমনই এই নাটকের ভাবনা, আলোক পরিকল্পনা, পোশাক পরিকল্পনা সবই করেছেন দেবব্রত। ফলে নাটকের নির্মাণে এক আশ্চর্য সাম্য আগাগোড়া দেখা যায়। যে রঙ নাটকের চরিত্রদের পোশাকে ব্যবহার করা হয়েছে, এমন ফ্যাকাশে, মূদু রঙের কারণে গল্পের ধূসরতা যেন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। দেবব্রত এই নাটকে প্রচুর ফ্লোর লাইটের ব্যবহার করেছেন। আসলে এটা পৃথিবীর আঁতের কথা, একেবারে পৃথিবীর গর্ভে লুকানো মানুষের বেঁচে থাকার কথা। সেখানে এই আলোর পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে এই নাটকে।
এই নাটকে অভিনয় করেছেন অজয় বিশ্বাস, সুরজিৎ বালা, সুজয় চক্রবর্তী, পুবালী গঙ্গোপাধ্যায়, চয়ন পণ্ডিত, মৌমিতা মণ্ডল, প্রিয়াঙ্কা দাস। এই নাটক এমনই যে নাটকের এই সাতজন অভিনেতাকে নিজের অভিনয় এক তারে বাঁধতে হবে। সেই বাঁধুনির কাজটি দারুণ দক্ষতায় করেছেন দেবব্রত। সমান কৌশলে পারদর্শী এই অভিনেতারাও। তাঁরা ছবিকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
আসলে আমরা কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। যোগ্যতমের উদ্বর্তনের লড়াইয়ে আমরা কখন সমস্ত সম্পর্ককে অস্বীকার করে হেঁটে চলে যাচ্ছি তা আমরা জানি না। আমরা জানি না, কঠিন সময়ে আমাদের পাশে কেউ থাকবেন না। সন্দেহ করতে আমরা এসে দাঁড়াব নিজের প্রতিবিম্বের কাছে বা ছায়ার কাছে। তারপর কোনও এক মুহূর্তে নিজের ছায়াকেই সন্দেহ করতে শুরু করব। তারপর, কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? উত্তর খোঁজে এই নাটক।
